৪৮/১. সাঁই
God (গড)/ ‘رسول’ (রাসুল)
ভূমিকা (Prolegomenon)
এটি ‘বাঙালী পৌরাণিক চরিত্রায়ন সত্তা সারণী’ এর ‘পালনকর্তা’ পরিবারের গুরুত্বপূর্ণ একটি ‘বাঙালী পৌরাণিক রূপক পরিভাষা’। এর ‘বাঙালী পৌরাণিক মূলক সত্তা’ ‘পালনকর্তা’। এর ‘বাঙালী পৌরাণিক উপমান পরিভাষা’ ‘অমৃতসুধা, গ্রন্থ, চন্দ্র, জল১, তীর্থবারি, পাখি৬, ফল ও ফুল১’। এর ‘বাঙালী পৌরাণিক চারিত্রিক পরিভাষা’ ‘ননি, বিষ্ণু, মাণিক, রাজা, রাম, লালন, স্বরূপ ও হরি’ এবং এর ‘বাঙালী পৌরাণিক ছদ্মনাম পরিভাষা’ ‘ঈশ্বর, উপাস্য, চোর, পতিতপাবন, পরমগুরু, প্রভু, মনের-মানুষ ও সুধা’।
অভিধা (Appellation)
সাঁই১ অব্য বাতাস চলাচলের অনুচ্চার ধ্বনি {ধ্বন্যা}
সাঁই (বাপৌরূ)বি পালনকর্তা, ঈশ্বর, বুদ্ধ, পতি, স্বামী, God, ‘رسول’ (রাসুল) (প্র) বাংলা শ্বরবিজ্ঞানে বর্ণিত বাঙালীদের পালনকর্তা বিশেষ (পরি) এমন তরল-মানুষ; যে এখনও মূর্তাকার ধারণ করে নি। মাতৃগর্ভে ভ্রূণ লালনপালনের দায়িত্ব পালনকারী সুমিষ্ট, সুপেয় ও শ্বেতবর্ণের জল (শ্ববি) উপাস্য, নারায়ণ, নিধি, নিমাই, নিরঞ্জন, স্বরূপ (ইপৌচা) খোদা (ফা.ﺨﺪﺍ), মা’বুদ (আ.ﻤﻌﺑﻭﺪ), মুহাম্মদ (আ.ﻤﺤﻤﺪ), রাসুল (আ.رَسُول) (ইপ) কাওসার (আ.ﻜﻭﺛﺮ), ফুরাত (আ.ﻔﺭﺍﺖ) (ইংপ) God, nectar, elixir (দেপ্র) এটি ‘বাঙালী পৌরাণিক চরিত্রায়ন সত্তা সারণী’ এর ‘পালনকর্তা’ পরিবারের ‘বাঙালী পৌরাণিক রূপক পরিভাষা’ ও বাঙালী পৌরাণিক ‘পালনকর্তা দেবতা’ বিশেষ (সংজ্ঞা) ১. সাধারণত; সারা জগতের পালনকর্তাকে বাংলায় ‘সাঁই’ বলা হয় ২. বাঙালী শ্বরবিজ্ঞানে ও বাঙালী পুরাণে, জরায়ুর মধ্যে সর্ব জীবের ভ্রূণ লালনপালনে নিয়োজিত সুমিষ্ট ও সুপেয় শ্বেতবর্ণের অমৃতরসকে রূপকার্থে ‘সাঁই’ বলা হয় (বাপৌছ) ঈশ্বর, উপাস্য, চোর, পতিতপাবন, পরমগুরু, প্রভু, মনের মানুষ ও সুধা (বাপৌচা) ননি, বিষ্ণু, মাণিক, রাজা, রাম, লালন, স্বরূপ ও হরি (বাপৌউ) অমৃতসুধা, গ্রন্থ, চন্দ্র, জল১, তীর্থবারি, পাখি৬, ফল ও ফুল১ (বাপৌরূ) সাঁই (বাপৌমূ) পালনকর্তা {বাং. সাদা+ বাং. ঈশ্বর> (সা+ঈ)> সাঈ>}
সাঁইচারী (বাপৌছ)বি সাঁইজি, বৈষ্ণব, সাঁইদর্শনকারী সাধক সাধিকার উপাধি বিশেষ বিণ সাঁইবিহারী (প্র) সাঁই বা লালনপালনকর্তার সাথে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে দর্শনলাভকারী।
সাঁইজি (বাপৌছ)বি প্রাণনাথ, প্রাণপতি, প্রাণস্বামী, প্রাণেশ্বর, বিশ্বনাথ, বিশ্বপতি বিণ বৈষ্ণব, সাঁইবিহারী, সাঁইচারী, Godship, Godlike, ‘ربوبيته’ (রুবুবিয়াতাহু), ‘ربي’ (রাবি), ‘إلهية’ (ইলহিয়া) (প্র) ১. সাঁইদর্শনকারী সাধক সাধিকার উপাধি বিশেষ ২. সাঁই বা লালনপালনকর্তার সাথে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে দর্শনলাভকারী ৩. বাংলা শ্বরবিজ্ঞানের আউল, বাউল, নাড়া, সাঁইজি ও কাঁইজি এ পঞ্চ পথের চতুর্থ পথ বিশেষ ৪. ভারতীয় শ্বরবিজ্ঞানের পূজারী, বাউল, সাধু, বৈষ্ণব ও ব্রহ্মচারী এ পঞ্চ পথের চতুর্থ পথ বিশেষ ৫. আরবীয় এলমে রুহানিয়্যাত (ﻋﻠﻢ ﺮﻮﺤﺎﻨﻴﺔ) বা শ্বরবিজ্ঞানের আবিদ (ﻋﺎﺑﺪ), অলি (ﻮﻟﻰ), গাউস (ﻏﻮﺙ) ও কুতুব (ﻘﻄﺐ) এ চারটি পথের মধ্যে চতুর্থতম পথ বিশেষ ৬. জ্ঞানের নৈরাকার ও সিদ্ধি স্তর হতে এবং রসাশ্রয় ও রূপাশ্রয় হতে এ নৈরাকারপন্থী ‘সাঁইজি’ সম্প্রদায়ের উৎপত্তি (বাপু) বৈষ্ণব (ইপ) ‘إلهية’ (ইলহিয়া), নায়িবে রাসুল (ﻧﺎﺌﺐ ﺮﺴﻭﻞ) (ইংপ) Godship {বাং.সাঁই+ স.জি}
সাঁইদর্শন (বাপৌছ)ক্রি সাঁইয়ের সাথে মিলিত হওয়া, সাধনবলে মানবদেহ হতে সাঁইরস বা জীবজল আহরণ করা {বা.সাঁই>}
সাঁইবিহারী (বাপৌছ)বিণ সাঁইজি, বৈষ্ণব, সাঁইচারী, সাঁইদর্শনকারী সাধক সাধিকার উপাধি বিশেষ (প্র) সাঁই বা লালনপালনকর্তার সাথে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে দর্শনলাভকারী {বাং.সাঁই>}
সাঁইরাতি (বাপৌছ)বি কোজাগর, সাঁই সাধন রাত্রি, আনন্দরাত্রি (ইদে) ‘ﺸﺑﻰ ﺑﺭﺍﺀﺓ’ (শবই বরাত) (প্র) ১. বসন্তকালের রাত্রি ২. যে রাতে জীবের পালনকর্তা সাঁই দেহধামে অবতরণ করে। সাধকগণ তার সাথে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে দর্শনলাভ করে ধন্য হন।
সাঁইয়ের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্ধৃতি
(Some highly important quotations of God)
১. “অদেখা সাঁইয়ের দেখা, দেখবি যদি আয় যৌবনে, অটলের ঝাণ্ডা নিয়ে, এ বেণুবনে নিধুবনে।” (বলন তত্ত্বাবলী- ৩)।
২. “অনুমানে হয় না সাধন, হাজার মাসে সাঁই অবতরণ, ডাঙ্গাতে হলেরে মরণ, সাঁই বাঁধবে কী জালে।” (বলন তত্ত্বাবলী- ৩১০)।
৩. “অহল্যা পাষাণী ছিল, তোমার চরণধুলায় মানবী হলো, লালন পথে পড়ে রইল, যা করেন সাঁই দয়াময়।” (পবিত্র লালন- ১৫৬/৪)।
৪. “আকার কী নিরাকার সাঁই রাব্বানা, আহাম্মদ আর আহাদ নামের, বিচার হলে যায় জানা।” (পবিত্র লালন- ৬৫/১)।
৫. “আকাশে সাঁই ঠাঁই নিয়েছে, পাহাড়ের চূড়ায়, নয়া বিজয়ের ডাক এসেছে, প্রতিপদে পূর্ণিমায়।” (বলন তত্ত্বাবলী- ৮)।
৬. “আপন গর্ভে রেখে পতি, অনূঢ়া হয় গর্ভবতী, জলের মাঝে জ্বলছে বাতি, আকাশে বসিয়া সাঁই।” (বলন তত্ত্বাবলী, বলন কাঁইজি)।
৭. “আপন ঘরের খবর নেনা, অনায়াসে দেখতে পাবি, কোনখানে সাঁইর বারামখানা।” (পবিত্র লালন- ১৬০/১)।
৮. “আপনার জন্মলতা, জানগে তার মূলটি কোথা, লালন কয় হয় সেথা, সাঁইয়ের পরিচয়।” (পবিত্র লালন- ৮৮৬/৪)।
৯. “একেক দেশে একেক বাণী, পাঠান কী সাঁই গুণমনি, মানুষের রচিত জানি, লালন ফকির কয়।” (পবিত্র লালন- ৩০৫/৪)।
১০. “করে অতি আজব ভাক্কা, গঠেছে সাঁই মানুষ-মক্কা, কুদরতি নূর দিয়ে, ও তার চারদ্বারে চার নূরের ইমাম, মধ্যে সাঁই বসিয়ে।” (পবিত্র লালন- ৮০/১)।
১১. “কী কালাম পাঠালেন আমার, সাঁই দয়াময়, একেক দেশে একেক বাণী কয় খোদা পাঠায়।” (পবিত্র লালন- ৩০৫/১)।
১২. “কোন প্রেমের প্রেমিকা ফাত্বিমা, সাঁইকে করেন পতি ভজনা, কোন প্রেমের দায়- ফাত্বিমাকে সাঁই, মা বোল বলেছে।” (পবিত্র লালন- ৬০০/৩)।
১৩. “ডুবে দেখ রে মন, প্রেমনদীর জলে, (মীন রূপে সাঁই খেলে), প্রেমডুবুরী না হলে মীন, বাঁধবে না জালে।” (পবিত্র লালন- ৪৮৩/১)।
১৪. “ত্রিবেণীর ত্রি-ধারে, মীন রূপে সাঁই বিহার করে, তুমি ওপর ওপর বেড়াও ঘুরে, সে গভীরে ডুবলে না।” (পবিত্র লালন- ৯২২/২)।
১৫. “নদী কিংবা বিল বাওড় খাল, সর্বস্থলে এক সে জল, একা মোর সাঁই– আছে সর্ব ঠাঁই, মানুষ রূপে হয় রূপান্তার।” (পবিত্র লালন- ৯২৬/২)।
১৬. “নিঠাঁইয়েতে সাঁইপুকুরে, না ডুবিলে সে গভীরে, যেখানে সাঁই চলেফেরে, সেখানে না গেলে।” (বলন তত্ত্বাবলী- ৩১০)।
১৭. “নিঠাঁইয়েতে সাঁই পাড়িতে, কত ভরা ডুবে ডাঙ্গাতে, কেউ কেউ পায় সহজেতে, বিশ্বাসী গুরুর কৃপায়।” (বলন তত্ত্বাবলী- ১২৬)।
১৮. “নিশিদিনে চোরের হানা, কী ধন লুটে টের পায় না, বলন কয় সাঁই এলো না, মহাকাল শমন এলো।” (বলন তত্ত্বাবলী, বলন কাঁইজি)।
১৯. “পাপী অধম তরাতে সাঁই, পতিতপাবন নাম শুনতে পাই, সত্য-মিথ্যা জানব হেথায়, তরাও যদি আজ আমায়।” (পবিত্র লালন- ৩৭৩/৩)।
২০. “যেখানে সাঁইর বারামখানা, শুনলে মন চমকে ওঠে, দেখতে যেমন ভুজঙ্গনা।” (পবিত্র লালন- ৮২৮/১)।
২১. “রাখলেন সাঁই কূপজল করে, আন্ধেলা পুকুরে।” (পবিত্র লালন- ৮৬০/১)।
২২. “সাঁই আমার কখন, খেলে কোন খেলা, জীবের কী সাধ্য আছে, গণেপড়ে তাই বলা (পবিত্র লালন- ৯৩২/১)।
২৩. “সাঁই আমার জলের ব্যাপারী, সাধু হলো হাজারী, শূন্যে সাঁইয়ের সহস্র কোঠা, পঞ্চাশ হাজার কাচারী।” (বলন তত্ত্বাবলী- ১৩৫)।
সাঁইয়ের কয়েকটি সাধারণ উদ্ধৃতি (Some ordinary quotations of God)
১. “এক দমের ভরসা নাই, কখন কী করবে গো সাঁই, তখন কার দিবি দোহাই, কারাগারে।” (পবিত্র লালন- ১৯৯/২)।
২. “এ মানুষ খুঁজিলে মিলে, ব্রহ্মা বিষ্ণু শিব নিতাই, এ মানুষে বিরাজ করে, দয়াল গুরু সাঁই কাঁই।” (বলন তত্ত্বাবলী- ৪৩)।
৩. “কাঁই ব্রহ্মা বিষ্ণু সাঁই, নিরাকার কোথাও লেখা নাই, গোল বেঁধেছে কুলের ধোঁকায়, সেই ইঙ্গিত বুঝলি না।” (বলন তত্ত্বাবলী- ১৬৮)।
৪. “কোথায় আছেরে দিন-দরদী সাঁই, চেতনগুরুর সঙ্গ লয়ে, খবর করো ভাই।” (পবিত্র লালন- ৩৫০/১)।
৫. “কোন পথে সাঁই ঘুরেফেরে, কাঁই আসে কয়দিন পরে, কোন গলিতে নিরীক্ষ ধরে, বসে থাকি ত্রিবেণে।” (বলন তত্ত্বাবলী- ১৬৭)।
৬. “ঘর আছে নাইরে গলি, তাপেতে সাঁই ওঠে ফুলি, নিগূঢ় ঘরের দুয়ার খুলি, সে পূজা কর বরাবর।” (বলন তত্ত্বাবলী- ১৪৩)।
৭. “জলের মধ্যে পবিত্রজল, শুন্যেতে সাঁই সাদাজল, ধরতে গেলে হয় তলাতল, সাধুজন বড়পাঁজি।” (বলন তত্ত্বাবলী- ২২৯)।
৮. “ডাঙ্গায় কী মিলে (সাঁই), রসাতলে না ডুবিলে, হাপুরহুপুর ডুব পাড়িলে।” (বলন তত্ত্বাবলী- ৩১০)।
৯. “তীর্থে কে কে যাবি আয় সাঁই দরশনে ভাই, আশিজন যাত্রী নিয়ে বিলাপী নৌকায়।” (বলন তত্ত্বাবলী- ১৩২)।
১০. “ত্রিজগতের মূলাধার সাঁই, জন্ম-মৃত্যু কিছু নাই, সিরাজ সাঁইজি কয় লালন তাই, থাক সদাই ঠিক জেনে।” (পবিত্র লালন- ৪৭৪/৪)।
১১. “ত্রিধারায় নিঠাঁই ঘরে, বড় নিগমে চলেফেরে, বলন কয় অপরূপ সাঁই, বাস করে খুপরির ভিতর।” (বলন তত্ত্বাবলী- ২৪২)।
১২. “দক্ষিণা বাতাসের পরে, ঐ মহাযোগ ভরা জোয়ারে, সাধিবে তিনযুগ ধরে, বলন কয় নিরালায়, সপ্ততল পাতাল হতে, ভেঁসে উঠবে দয়াল সাঁই।” (বলন তত্ত্বাবলী- ৭)।
১৩. “দুই পাহাড়ের মধ্যখানে, সাঁইয়ের গোপন পূজাঘর, অষ্টজনে কাঁধে করে, বহে সারা বিশ্বপর।” (বলন তত্ত্বাবলী- ১৪৩)।
১৪. “দ্বিদলে মোর সাঁই দরদী, স্বরূপনালে রয় নিরবধি, অটলখেলা খেলবি যদি, আগে কর গুরু ভজনা।” (বলন তত্ত্বাবলী- ১৮)।
১৫. “ধনুকধারী ঐ বিষ্ণুপুরী, সাঁই কফিনে বংশীধারী, হলেরে মন সু কারবারী, অধর এসে দেয় ধরা।” (বলন তত্ত্বাবলী- ১৮৯)।
১৬. “নামে বিষ্ণু ব্রহ্মা সাঁই, একখানে রহে তিনজনাই, কাঁইজি বলন ভাবিয়া জানায়, মানবের ঊর্ধ্বে নয় তারা।” (বলন তত্ত্বাবলী- ১৮৯)।
১৭. “নিগূঢ়ে নিগমেতে সাঁই জলাকার স্বরূপ ধরি, নীরাকারে চলেফেরে বলিতে সে রূপ ডরি, হাজার মাস হলে তাপন- নীরাকার হয় নিরঞ্জন, জলাকারে হয় বরিষণ- বানে ভাসে জন্মনালা।” (বলন তত্ত্বাবলী- ১৪০)।
১৮. “নিঠাঁইয়ে বাস করে সাঁই মহাশূন্যের অমরায়, পাবি না গয়া বিরজায় সুরধুনী আর মক্কায়।” (বলন তত্ত্বাবলী- ১৬৩)।
১৯. “নিতাইশালের নদীয়াতে, নিরাকার সাঁই রয় আকারেতে, ধরতে সাঁই– ডুবে মনরায়, সাধুর পদ সেবা কর।” (বলন তত্ত্বাবলী- ২৭৪)।
২০. “পড়লে সাঁইয়ের কোপানলে, আরেক জনম থাকবি জেলে, বলন কয় ভেদ জানিলে, পাবি সাঁইয়ের ভেলকিবাজি।” (বলন তত্ত্বাবলী- ২২৯)।
২১. “বড় নিগম ঘরে আছেন সাঁই, যে ধামেতে বাস করেন সে, সেথা চন্দ্র-সূর্যের কিরণ নাই।” (পবিত্র লালন- ৬৬৮/১)।
২২. “বিলায়াত স্বরূপ নিশানি, উজান ভাটি দুই ধারাতে ভাঁসে সাঁই জগৎস্বামী।” (বলন তত্ত্বাবলী- ২১৪)।
২৩. “ভক্তের দ্বারে বাঁধা আছেন সাঁই, হিন্দু কী যবন বলে, জাতির বিচার নাই।” (পবিত্র লালন- ৭০৭/১)।
২৪. “ভাণ্ড ব্রহ্মাণ্ড মাঝে, সাঁই বিনা কী খেলা আছে, লালন কয় নাম ধরেছে, কৃষ্ণ করিম কালা।” (পবিত্র লালন- ৯৩২/৪)।
২৫. “ভোলা মন দেখরে সাঁইজির রঙ্গিন ভোজবাজি, ত্রিবেণীতে দুরঙ্গেতে দ্বিকর্তা সাঁই কাঁইজি।” (বলন তত্ত্বাবলী- ২২৯)।
২৬. “মনরে নিগম নিঠাঁইয়ে, সাঁই বেন্ধেছে কী ঘর, তিল পরিমাণ আবাসের পর, গড়িয়া ঊর্ধ্বনগর।” (বলন তত্ত্বাবলী- ২৪২)।
২৭. “মনরে যে পথে সাঁইয়ের আসা যাওয়া, তাতে নাই মাটি আর হাওয়া।” (পবিত্র লালন- ৭৪৯/১)।
২৮. “মরার অগে মরে যে জন, অনায়াসে পায় সাঁই দরশন, সার্থক হয় মানব জনম, বসে থাক সে আশাতে (বলন তত্ত্বাবলী, বলন কাঁইজি)।
২৯. “মিছে পরি কোপনি বালা, মনে রয় রমণের জ্বালা, বলন কয় লীলাখেলা, সকলই সাঁই চিনিতে।” (বলন তত্ত্বাবলী, বলন কাঁইজি)।
৩০. “যেতে পথে সাঁইসাগরে, কত ধনী ডাঙ্গায় মরে, বলন কয় নাই কিনারে, সাঁই থাকে রসাতলে।” (বলন তত্ত্বাবলী- ৩১০)।
৩১. “যেদিন সাঁই হিসাব নিবে, আগুন পানির তুফান হবে, বিষয়রাশি কোথায় রবে, একবার ভেবে দেখ মনা।” (পবিত্র লালন- ৭৭৩/২)।
৩২. “যে পথে সাঁই চলেফেরে, সবায় চলে সে পথটি ধরে, কত জনাই পিছলে মরে, হাতড়ে ফিরে আন্দাজী।” (বলন তত্ত্বাবলী- ২২৯)।
৩৩. “যেমন সবাই বলে দেহের সূর্য্য আকাশে নিয়া, তেমন আকাশের সাঁই ধরা পড়ে পাতালে গিয়া, বলন কয় খুঁজ সদাই, সাঁই ঘুরে নাকের কাছে।” (বলন তত্ত্বাবলী- ১৪৯)।
৩৪. “রসের রসিক না হলে, কে গো জানতে পায়, কোথায় সাঁই অটল রূপে বারাম দেয়।” (পবিত্র লালন- ৮৫৯/১)।
৩৫. “রাই প্রেমের তরঙ্গ ভারী, লালন বলে আহা মরি, হরি আর সাঁইয়ের মাঝে, কোনো তফাৎ নাই।” (পবিত্র লালন- ৪৯৫/৪)।
৩৬. “রূপ-কাষ্ঠের নৌকায় চড়ে মাসেমাসে হয় উদয়, কলির জীব তরাতে সাঁই ঘুরতেছে এ জগৎময়, প্রাতঃ সন্ধ্যা দুই ধারাতে- পার করে পার ঘাটাতে, হাত ধরি কাঙ্গলের হাতে- পেলে সঠিক সন্ধানী।” (বলন তত্ত্বাবলী- ২১৪)।
৩৭. “শুদ্ধ প্রেম সাধিলে সাধু, প্রেমকুঠিতে লাগে যাদু, তের মাস খায় সে মধু, ভাঙ্গিয়া সাঁই নিগমকারা।” (বলন তত্ত্বাবলী- ১৮৯)।
৩৮. “সকাল সন্ধ্যা নিরবধি, চলেফেরে সাঁই দরদী, দুই মৃণালে কর সন্ধি, নিরীক্ষ ধর বায়ু ঘরে।” (বলন তত্ত্বাবলী- ২১)।
৩৯. “সাঁই আকাশে ঠিকানা দিয়া, বাস করে পাতালে গিয়া, যত রাখ মোহ দিয়া, হারা হবি তার নাগাল।” (বলন তত্ত্বাবলী- ২২০)।
৪০. “সাঁইয়ের অন্তপুরি গোলকধামে, যাব বলরে কোন সাধনে।” (বলন তত্ত্বাবলী- ২৮৪)।
৪১. “সাঁই সুভ্ররসের উপাসনা কুঁড়ে মন তোর হলো না, কোথায় মূলাধার-স্রাবস্তি একবার ভেবে দেখলি না।” (বলন তত্ত্বাবলী- ২৮৬)।
৪২. “হলে সাঁই কাঁই সন্ধান করা, মানবকর্মের হয়রে সারা, পরপারে যায় সাধু ঋষিরা, বলন কাঁইজি কয় ভুবনে।” (বলন তত্ত্বাবলী- ১৬৭)।
৪৩. “হায় হায় পূর্ণিমা রজনী এলে, সাত আকাশের দুয়ার খোলে, সত্তর হাজার পর্দা খোলে, দেখা দিবে দয়াল সাঁই, পঞ্চাশ হাজার বছর, নিরীক্ষ ধরে থাকা চাই।” (বলন তত্ত্বাবলী- ৭)।
৪৪. “হায় হায় হাজার বছর পাঞ্জা লড়ে, সাঁই আসে বাতাসে উড়ে, দ্বিদলে সাঁই নড়েচড়ে, মানুষ ছাড়া নাই ঠাঁই, রক্তিমধারা পাড়ি দিয়ে, বস গিয়ে সাদা ধারায়।” (বলন তত্ত্বাবলী- ৭)।
সাঁইয়ের সংজ্ঞা (Definition of God)
সাধারণত; সারা জগতের পালনকর্তাকে সাঁই বলে।
সাঁইয়ের আধ্যাত্মিক সংজ্ঞা (Theological definition of God)
বাঙালী শ্বরবিজ্ঞানে ও বাঙালী পুরাণে; জরায়ুর মধ্যে দ্বিপস্থ জীবের ভ্রূণ লালনপালনে নিয়োজিত জলকে রূপকার্থে সাঁই বলে।
সাঁইয়ের প্রকারভেদ (Variations of God)
বাঙালী শ্বরবিজ্ঞানে ও বাঙালী পুরাণে; সাঁই দুই প্রকার। যথা; ১. উপমান সাঁই ও ২. উপমিত সাঁই।
১. উপমান সাঁই (Analogical God)
সাধারণত; সারা জগতের পালনকর্তাকে উপমান সাঁই বলে।
২. উপমিত সাঁই (Compared God)
বাঙালী শ্বরবিজ্ঞানে ও বাঙালী পুরাণে জরায়ুর মধ্যে দ্বিপস্থ জীবের ভ্রূণ লালনপালনে নিয়োজিত জলকে উপমিত সাঁই বলে।
সাঁইয়ের পরিচয় (Identity of God)
এটি ‘বাঙালী পৌরাণিক চরিত্রায়ন সত্তা সারণী’ এর ‘পালনকর্তা’ পরিবারের একটি ‘বাঙালী পৌরাণিক রূপক পরিভাষা’ বিশেষ। বাঙালী রূপকার মনীষীদের সারা জগতের পালনকর্তাকে সাঁই বলা হয়। মৌমাছি ফুল হতে সুধারস আহরণ করে মৌচাকে সঞ্চয় করলে আমরা তাকে মধু বলি। এ অমৃতরসটিই বিশ্বের সর্বজীবের লালনকর্তা। এ রসটিই প্রকৃত বিশ্বকর্মা এবং এ রসই সর্বজীবের লালনপালনে নিয়োজিত একমাত্র সত্তা। শ্বরবিজ্ঞানে; এ রসকেই সাঁই বলা হয়।
কী উদ্ভিদ কী দ্বিপস্থ জীব সর্বপ্রকার জীবের জরায়ুতে জীবভ্রূণ লালনপালনের পরিপূর্ণ কাজটি একমাত্র সাঁইই করে থাকেন। এজন্য; সাঁইকে বিশ্বের প্রতিপালক বলা হয়। বলা হয় “সবার ওপরে সাঁই, তার ওপরে নাই।” আরও বলা হয় কেবল সাঁই বিশ্বের সব প্রশংসা পাবার যোগ্য। এজন্য; বিশ্বের সব পুরাণ বা সাম্প্রদায়িক গ্রন্থের সব রূপকাররা কেবল সাঁইয়ের প্রশংসাই পঞ্চমুখ। এ সত্তাটিকে আরব্য শ্বরবিজ্ঞানের চরিত্র রূপে মুহাম্মদ (ﻤﺤﻤﺪ), রব (ﺭﺐ) ও রাসুল (ﺮﺴﻮﻞ) এবং পানীয় বস্তু রূপে কাওসার (আ.ﻜﻭﺛﺮ), ফুরাত (আ.ﻔﺭﺍﺖ), সালসাবিল (ﺴﻟﺴﺒﻴﻞ) ও যানজাবিল (ﺯﻧﺠﺒﻴﻞ) বলা হয়। আবার পারসিক শ্বরবিজ্ঞানের চরিত্র রূপে খোদা (ফা.ﺨﺪﺍ) এবং পানীয় বস্তু রূপে আবকাউসার (ﻜﻭﺛﺮ ﺁﺐ), আবজমজম (ﺯﻤﺯﻢ ﺁﺐ) ও আবহায়াত (ﺤﻴﺎﺖ ﺁﺐ) বলা হয়। আবার ইংরেজি শ্বরবিজ্ঞানের চরিত্র রূপে God এবং উত্তম পানীয় বস্তু রূপে তাঁকে nectar বা elixir বলা হয়। এছাড়াও; সংস্কৃত ভাষায় এঁকে বিষ্ণু এবং পালি ভাষায় এঁকে বুদ্ধ বলা হয়। আবার বাংলা ভাষায় শ্বরবিজ্ঞানের চরিত্র রূপে দয়াল, গুরু, গোঁসাই, মনের-মানুষ, ভাবের-মানুষ ইত্যাদি এবং উত্তম পানীয় বস্তু রূপে এঁকে অমৃত, অমৃতসুধা, অমৃতমেঘের বারি ও মিষ্টিবারি বলা হয়। এছাড়াও; বড়পির, খাজাবাবা, নেংটাবাবা, লালন ও লোকনাথ ইত্যাদি আধুনিক নামগুলো দ্বারাও কেবল সাঁইকেই বুঝায়। এবার বলা যায় বিষ্ণু, বুদ্ধ, লালন, সাঁই, খোদা, মুহাম্মদ, রব, রাসুল ও গড ইত্যাদি পরিভাষা মধ্যে কেবল ভাষাগত পার্থক্য ব্যতীত সত্তাগত বা অভিধাগত কোনো পার্থক্য নেই।
সাধুগণ অটল সাধনবলে সাঁইয়ের সন্ধানলাভ করেন। শ্বরবিজ্ঞানে; সাঁইকেই জীবের স্বরূপ বা সাকার বলা হয়। বর্তমান চিকিৎসকরা যদিও পুরুষের শুক্রাণু ও নারীদের ডিম্বাণু ব্যাপারে অনেক অনেক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেছেন। তবুও; শ্বরবিজ্ঞানের প্রাথমিক ধারণা হতেই সাঁইকে মানুষ বলা আরম্ভ হয়েছে এবং তা আজও বলা হচ্ছে। কিন্তু তা আজ পর্যন্ত কোনো চিকিৎসা বিজ্ঞানীই ভুল প্রমাণ করতে পারেন নি। কারণ; বাস্তবেও দেখা যায় ডাবের জলই ক্রমে ক্রমে গাঢ় হয়ে শাস হয় এবং শাস হতে অঙ্কুর গজিয়ে ডাবগাছে পরিণত হয়। তেমনই; ডিমের মধ্যে অবস্থিত তরল পদার্থই গাঢ় হয়ে পরবর্তীকালে কুক্কুটের সদ্যজাত ছানা হয়ে বাইরে আসে। এজন্য; আমরা প্রাথমিকভাবে বলতে পারি জরায়ুর সুমিষ্টজল ক্রমে ক্রমে কঠিন হতে কঠিনতর হয়ে জীবাকৃতি ধারণ করছে। যারফলে; বলা যায় সাঁই নিজেই জীব। সাঁই স্বরূপ হতেই ক্রমে ক্রমে জীব রূপে আত্মপ্রকাশ করছেন। অর্থাৎ; আমিই সাঁই ও সাঁইই আমি।
আমরা আলাপী ও গণকযন্ত্রের বেলা দেখতে পাই যন্ত্রাদি Hardware ও Software দুভাগে বিভক্ত। Hardware হলো যন্ত্রাদির কঠিন অংশ এবং Software হলো যন্ত্রের কোমল অংশ। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় যন্ত্রের কোমল অংশই হলো যন্ত্রের প্রকৃত চালিকাশক্তি। কেবল কঠিন অংশ সংযুক্ত করে ছেড়ে দিলেই যন্ত্রাদি সচল হয় না। তারমধ্যে; অনেক কোমল অংশ উত্তোলন করার পরই কেবল যন্ত্রাদি সচল হয়।
তেমনই; মানবদেহ নামক এ কাঠামোটিকে সচল করার জন্য এর মধ্যে আত্মা, মন ও জ্ঞান নামক অদৃশ্য-সত্তা উত্তোলন করা হয়। একমাত্র সাঁইই মানবদেহের মধ্যে এ অদৃশ্য-সত্তা পুনঃ সংস্থাপন করে থাকেন। মৈথুনে শুক্রপাতের মাধ্যমে আন্তযোগাযোগ ব্যবস্থাশূন্য অবস্থায় যখনই একটি শুক্রাণু পুনঃ জরায়ুতে প্রবেশ করে ভ্রূণ রূপে দেহ ধারণ করে তখনই আবার নতুন করে উক্ত দেহের মধ্যে আন্তযোগাযোগ পদ্ধতি বা Software সাঁইজি সংস্থাপন করে দেন এবং দীর্ঘ সময় ভ্রূণ লালনপালন করে সন্তান ভূমিষ্ঠ করিয়ে দেন। অর্থাৎ; শূন্যদেহ নামক Hardware মধ্যে সাঁইজি আবার আন্তযোগাযোগ পদ্ধতি বা Software লোর্ড করে দেন। তাই; জীবদেহ আবার সচল হয়।
সব জীব জন্মান্তর গ্রহণের পর বাহ্যিকভাবে কেবল চামড়াটা পরিবর্তন করে বটে কিন্তু দৈহিক কাঠামোর কোনো পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায় না। শিশু জীবের মধ্যে আত্মা, মন ও জ্ঞান সংস্থাপন করা একমাত্র সাঁইয়ের কাজ। এজন্য; সাঁইকে বিশ্বকর্মা বলা হয়। সাঁই সর্ব জীবের জরায়ুতে বসে কেবল দেহবিশ্ব সৃষ্টি করেন এবং আবার নতুন করে জীবের মধ্যে আত্মা, মন ও জ্ঞান সংস্থাপন করে থাকেন। তাই; এককথায় বলা যায় কেবল সাঁইই একমাত্র জগৎকারক, জগৎকাণ্ডারী ও বিশ্বের প্রতিপালক।
সাঁই দেবতা দ্বারা নির্মিত একটি চমৎকার
(The miracle created by the God angel)
একদিন সাঁইজি কিছু শিষ্যভক্ত নিয়ে এক নদীর পাড়ে গিয়ে উপস্থিত হলেন। নৌকার সন্ধান না পেয়ে তিনি একটি গাছের নিচে বসে পড়লেন। একজন শিষ্য বললেন; “সাঁইজি নৌকা না পেলে যাওয়ার কী কোনো পথ নেই?” সাঁইজি বললেন; “আছে যদি তোমরা সবাই নিচে ওপরে ডানে বামে সামনে ও পিছনে না তাকিয়ে কেবল আমার প্রতি তাকিয়ে থাকতে পারো তবে জলের ওপর দিয়েই নদী পার হওয়া যাবে।” সাঁইজির এমন কথা শুনে সবাই সাগ্রহে বললেন; “সাঁইজি আমরা তাই করব।” সাঁইজির পিছে পিছে শিষ্যরা সবাই সাঁইজির মুখপানে চেয়ে জলের ওপর দিয়ে হেঁটে নদী পার হয়ে ওপারে গেলেন। হরিণের যদি কুস্তরী হয়, গোরুর যদি গোরস হয়, ঝিনুকে যদি মুক্তা হয় তবে মানুষের মধ্যে এমন মূল্যবান পদার্থ না হওয়ার কিবা কারণ থাকতে পারে?
সাঁই দেবতাকে অবতার বলার কারণ কী?
(What cause to say incarnation to the God angel?)
অবতার বিণ প্রকাশক, বাহক, মূর্তিমানরূপ, অবতরণকারী (প্র) দেবতাগণ সময়ে সময়ে মানুষ্য-মূর্তি পরিগ্রহ করে পৃথিবীতে আগমন করেন বা আবির্ভূত হন। পৌরাণিক যুগে বিষ্ণু নিম্নোক্ত দশবার অবতরণ করেন; ১. মৎস্য ২. কূর্ম ৩. বরাহ ৪. নৃসিংহ ৫. বামন ৬. পরশুরাম ৭. রামচন্দ্র ৮. কৃষ্ণ ৯. বুদ্ধ ও ১০. কল্কি (শ্ববি) নরদেহে দাড়ি, মুচ ও দন্ত এবং নারীদেহে স্তন, দুগ্ধ, রজস্রাব, সাঁই, কাঁই ও দন্ত ইত্যাদি দেবতা।
অবতারের সংজ্ঞা (Definition of incarnation)
১. বাঙালী শ্বরবিজ্ঞানে ও বাঙালী পুরাণে; শ্বাস, কম্পন ও ভাবযোগে যে মহামনীষীগণ ঐশিবাণী, ঐশিবার্তা, দৈববাণী ও দৈববার্তগুলো অনুধাবন করে বিশ্বাবাসীর কল্যাণে তা প্রচার প্রসার করেন তাকে যাজক বা অবতার বলে।
২. বাঙালী শ্বরবিজ্ঞানে ও বাঙালী পুরাণে; মানুষ রূপে জন্মগ্রহণ করে জ্ঞান ও সাধনা দ্বারা অর্জনকৃত দৈহিক ও মানসিক সূক্ষ্ম তত্ত্বগুলো মানবসমাজে রূপকার্থে প্রচারকারী যাজক বা রূপকারকে অবতার বলে।
অবতারের গুণাবলী (Attributes of incarnation)
একজন অবতারের ৫টি গুণ অবশ্যয় থাকা প্রয়োজন। যথা;
১. সৃষ্টির আদিপর্ব ও অন্তপর্বের ওপর সম্যক-জ্ঞান অর্জন করা।
২. সমসায়িক শিক্ষাক্রম বা পাঠ্যক্রমগুলোর যে কোনো একটিতে সর্বোচ্চ উপাধি অর্জন করা।
৩. সমসাময়িক প্রচলিত বিজ্ঞান, দর্শন ও প্রযুক্তি সম্পর্কে অন্তত সাধারণ জ্ঞান অর্জন কর।
৪. বিশ্বের যে কোনো একটি সাম্প্রদায়িক সংস্কার সম্পর্কে অন্তত ভালোভাবে জ্ঞানার্জন করা।
৫. স্বস্ব ভাষায় চতুর্পথ, চতুর্স্তর, ষড়াশ্রয় ও অষ্ট-সত্তা এবং ‘বাঙালী পৌরাণিক মূলক সত্তা’, রূপক, ব্যাপক, প্রপক, ‘বাঙালী পৌরাণিক চরিত্রায়ন সত্তা সারণী’, ‘বাঙালী পৌরাণিক সংখ্যা সারণী’ ও সংখ্যা সূত্রগুলো সম্পর্কে সম্যক-জ্ঞান অর্জন করা।
অবতারের প্রকারভেদ (Variations of incarnation)
বাঙালী শ্বরবিজ্ঞানে ও বাঙালী পুরাণে অবতার দুই প্রকার। যথা; ১. দৈবাবতার ও ২. মানুষ অবতার।
১. দৈবাবতার (Seraphim)
মানবসন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর হতে ক্রমে ক্রমে মানবদেহে যেসব স্বায়ম্ভু-সত্তা আগমন করে তাদেরকে দৈবাবতার বলে। যেমন; দাড়ি, মুচ, শুক্র ও রজ ইত্যাদি।
২. মানুষ অবতার (Humanitarian)
সব মানুষকেই মানুষ অবতার বলে। যেমন; বুদ্ধ।
মানবকুলে মানুষ বেশে জন্মগ্রহণ করে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাদীক্ষা অর্জন করে মানুষ ও সৃষ্টিজীবের কল্যাণার্থে যারা আজীবন চেষ্টা-সাধনা করে অসংখ্য অমূল্যবাণী নির্মাণ করেন তারাই প্রকৃত মানুষাবতার। যেমন; লালন সাঁইজি ও বলন কাঁইজি।
ঐশিবাণী বা ঐশিবার্তা ধারণ ও প্রচারের দিক দিয়ে মানুষ অবতার তিন প্রকার। যথা; ১. রূপকার ২. প্রপকার ও ৩. প্রচারক।
১. রূপকার (Moulder)
যে মহামনীষীগণ ঐশিবাণী বা ঐশিইঙ্গিতের ওপর ভিত্তি করে রূপকার্থে দৈবসত্তগুলো ও লৌকিক সত্তাগুলো নির্মাণ করে বিশ্বাবাসীকে নৈতিক ও চারিত্রিক শিক্ষা প্রদান করে থাকেন তাদেরকে রূপকার বলে। যেমন; বেদব্যাস ও বাল্মীকি।
২. প্রপকার (Extensivetor)
যে মহামনীষীগণ মহান রূপকারগণের নির্মিত দৈবসত্তাগুলো ও লৌকিক সত্তাগুলো ব্যবহার করে বিশ্বাবাসীকে নৈতিক ও চারিত্রিক শিক্ষা প্রদান করার উদ্দেশ্যে আরও অভিনব লৌকিক সত্তাগুলো ও মহা গ্রন্থাদি নির্মাণ করেন তাদেরকে প্রপকার বলে। যেমন; লালনসাঁইজি ও জারির তাবারী।
৩. প্রচারক (Preacher)
যেসব মহামনীষী, সুমহান রূপকার ও প্রপকারগণের নির্মিত দৈবসত্তাগুলো, লৌকিক সত্তাগুলো ও রূপকার্থে নির্মিত মহা গ্রন্থাদি বিশ্ববাসীর বোধগম্য করানোর জন্য টীকা, টীপ্পনী বা সরল ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ প্রণয়ন করে প্রচার ও প্রসার করে থাকেন তাদেরকে প্রচারক বলে। যেমন; জালালুদ্দীন রুমী ও ইমাম গাজ্জালী।
দৈবাবতার ও মানুষ অবতারের মধ্যে পার্থক্য
(Difference between seraphim and humanitarian)
দৈব অবতার | মানুষ অবতার |
১. শ্বরবিজ্ঞানের ‘বাঙালী পৌরাণিক চরিত্রায়ন সত্তা সারণী’ এর ‘বাঙালী পৌরাণিক মূলক সত্তা এর রূপক নামে’ পৌরাণিক দেবতায়ন চরিত্রকে দৈবসত্তা বা দৈব অবতার বলে। যেমন; মদন। | ১. সব মানুষকে মানুষ অবতার বলে। যেমন; লালন সাঁইজি। |
২. দৈব অবতার মানুষে বিদ্যমান কোনো না কোনো বিষয়বস্তু। যেমন; ‘সাঁই’। | ২. মানুষাবতার সাধারণ মানুষ, সুবিজ্ঞ মনীষী বা আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্বগণ। |
৩. এটা ‘মানুষে বিদ্যমান বিষয়বস্তু ও ইন্দ্রিয়াদি’ এর রূপক নাম। যেমন; মানবদেহে বিদ্যমান এক প্রকার অমৃত জলের ‘বাঙালী পৌরাণিক রূপক পরিভাষা’ ‘সাঁই’। | ৩. এটা রক্তমাংসে গড়া দেহধারী মানুষ। |
৪. এটা পৌরাণিকভাবে দেবতায়ন চরিত্র। | ৪. এটা সাধারণ যে কোনো বিষয়ে বিশেষ বিজ্ঞ ও বিশেষজ্ঞ শ্রেণির দেহধারী মানুষ। |
৫. এটা ‘পৌরাণিক চরিত্রায়ন সত্তা সারণী’ এর মধ্যেই বিদ্যমান। | ৫. এটা মানব সমাজের মধ্যে বিদ্যামান। |
৬. এদের জন্ম ‘পৌরাণিক জন্মদিন নির্মাণ সূত্র’ দ্বারা নির্মিত। এদের মৃত্যু ‘পৌরাণিক মৃত্যুদিন নির্মাণ সূত্র’ দ্বারা নির্মিত। তাই; বরং এঁরা নিত্য ও অবিনশ্বর। | ৬. এদের বাস্তব জন্ম-প্রয়াণ রয়েছে বরং এঁরা অনিত্য ও নশ্বর। |
৭. এঁদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার প্রয়োজন হয় না বরং এঁরা ঐশ্বরিক শিক্ষায় শিক্ষিত। যেমন; জিহ্বা টক, ঝাল, মিষ্ট, তিক্ত, কটু, লবণ ও কষা স্বাদ আপনিই বুঝতে পারে। | ৭. মানুষ অবতারকে বিদ্যালয়ে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা অর্জন করতে হয় এবং অবশ্যই আধ্যাত্মিক গুরুর নিকট শ্বর জ্ঞান অর্জন করতে হয়। |
৮. এটি; পৌরাণিক চরিত্র রূপে ব্যবহৃত হয়। | ৮. এঁরা পুরাণ নির্মাণ করে। |
অবতারবাদ (Doctrine of incarnation)
‘মানুষে বিদ্যমান বিষয়বস্তু ও ইন্দ্রিয়াদি এর রূপক নামে” ঈশ্বরায়িত পৌরাণিক ঈশ্বর মানব বেশে জন্মগ্রহণ করিয়ে বা সরাসরি মানব বেশে অবতরণ করিয়ে আত্মদর্শন জ্ঞান প্রচার নিয়মকে অবতারবাদ বলা হয়। যেমন; দেহের কালো রসে ঈশ্বরায়িত পৌরাণিক ঈশ্বরের জন্মগ্রহণ করিয়ে আত্মদর্শন জ্ঞান প্রচার করা।
অথবা; শ্বরবিজ্ঞানের ‘বাঙালী পৌরাণিক চরিত্রায়ন সত্তা সারণী’তে বর্ণিত সৃষ্টিকর্তা ও পালনকর্তা ‘বাঙালী পৌরাণিক মূলক সত্তা এর রূপক নামে’ ঈশ্বরায়ন করে সৃষ্ট পৌরাণিক ঈশ্বর ব্রহ্মা ও বিষ্ণুর মাধ্যমে সরাসরি আত্মদর্শন জ্ঞান প্রচার নিয়মকে অবতারবাদ বলা হয়। যেমন; বটগাছের আত্মকাহিনী বটগাছের মুখ দিয়ে প্রকাশ করা।
ঐশিবাদ (Divineism)
‘মানুষে বিদ্যমান বিষয়বস্তু ও ইন্দ্রিয়াদি এর রূপক নামে” ঈশ্বরায়িত পৌরাণিক ঈশ্বরের জন্মগ্রহণ বা অবতরণ না করিয়ে দেবতার মাধ্যমে আত্মদর্শন জ্ঞান প্রচার নিয়মকে ঐশিবাদ বলা হয়। যেমন; দেহের কালো রসে ঈশ্বরায়িত পৌরাণিক ঈশ্বরের ঐশিবাণী দেবতার নিকট প্রেরণ করে আত্মদর্শন জ্ঞান প্রচার করা।
অথবা; শ্বরবিজ্ঞানের ‘বাঙালী পৌরাণিক চরিত্রায়ন সত্তা সারণী’তে বর্ণিত ইঙ্গিত ‘বাঙালী পৌরাণিক মূলক সত্তা এর রূপক নামে’ দেবতায়ন করে সৃষ্ট পৌরাণিক বলন দেবতার মাধ্যমে অন্যান্য দেবতা দ্বারা আত্মদর্শন জ্ঞান প্রচার নিয়মকে ঐশীবাদ বলা হয়। যেমন; বটগাছের আত্মকাহিনী তালগাছের মুখ দিয়ে প্রকাশ করা।
যেমন; বটগাছ ও তালগাছ কথা বলতে পারে না। তাই; কথা বলানোর জন্য; উক্ত বটগাছ ও তালগাছে অবশ্যই প্রাণায়ন (প্রতীকী প্রাণ প্রতিষ্ঠা করা) করে প্রাণীত করা প্রয়োজন। তারপর; বটগাছের আত্মকাহিনী বটগাছের মুখ দিয়েও প্রকাশ করানো যায়। আবার; বটগাছের আত্মকাহিনী তালগাছের মুখ দিয়েও প্রকাশ করানো যায়। অনুরূপভাবে; শিশ্ন ও যোনি কথা বলতে পারে না। তাই; শিশ্ন ও যোনির রূপক নামে দেবতায়ন করে অবশ্যই তাদের দেবতা ও দেবীর রূপদান করতে হবে। ধরি দেবত্বারোপণ (deification) করার পর শিশ্নের নাম বলাই এবং যোনির নাম কানাই। বলাইয়ের প্রেমাগুনের (কামোত্তেজনা যন্ত্রণা) কথা বলাইয়ের মুখ দিয়ে প্রকাশ করানো যায়। আবার; বলাইয়ের প্রেমাগুণের (কামোত্তেজনা যন্ত্রণা) কথা কানাইয়ের মুখ দিয়েও প্রকাশ করানো যায়।
এখানে যার কথা তার মুখ দিয়ে প্রকাশ করানোর নিয়মকে বলা হয় অবতারবাদ। যেমন; বটগাছের আত্মকাহিনী বটগাছের মুখ দিয়েও প্রকাশ করানো এবং বলাইয়ের প্রেমাগুনের (কামোত্তেজনা যন্ত্রণা) কথা বলাইয়ের মুখ দিয়ে প্রকাশ করানই অবতারবাদ।
অন্যদিকে; একজনের কথা অন্যজনের মুখ দিয়ে প্রকাশ করানোর নিয়মকে বলা হয় ঐশিবাদ। বটগাছের আত্মকাহিনী তালগাছের মুখ দিয়েও প্রকাশ করানো এবং বলাইয়ের প্রেমাগুণের (কামোত্তেজনা যন্ত্রণা) কথা কানাইয়ের মুখ দিয়েও প্রকাশ করানই ঐশিবাদ।
ঐশিবাদ ও অবতারবাদের পার্থক্য
(Difference between havenism and personifism)
ঐশিবাদ | অবতারবাদ |
১. ঐশিদূতদের মুখ দ্বারা পরোক্ষভাবে প্রকাশিত পুরাণকে ঐশিবাদ বলে। | ১. সুবিজ্ঞ আচার্য, ঋষি ও মনীষীদের প্রত্যক্ষভাবে প্রকাশিত পুরাণকে অবতারবাদ বলে। |
২. এটি; হলো পরোক্ষ উক্তি। | ২. এটি; হলো প্রত্যক্ষ উক্তি। |
৩. এটি; হলো নিজের কথা বিষয়বস্তুর মুখ দ্বারা প্রকাশকারী মতবাদ। | ৩. এটি; হলো নিজের কথা নিজের মুখ দ্বারা প্রকাশকারী মতবাদ। |
৪. এতে নিজের কথা দেবতাগণের মুখ দ্বারা প্রকাশ করা হয় বলে দেবতারূপ প্রবক্তার গুরুর প্রয়োজন হয় না। | ৪. এতে নিজের কথা নিজেই প্রকাশ করা হয় বলে প্রবক্তার গুরুর প্রয়োজন হয়। |
৫. এতে মানবদেহের সব স্বায়ম্ভুই স্বর্গীয় অবতার। যেমন; রজ, সুধা, মধু, মুচ, দাড়ি ও যৌবন ইত্যাদি। | ৫. এতে বিশিষ্ট বিশিষ্ট মহাসাধক সবাই মানুষ অবতার। যেমন; নজরুল, রবীন্দ্রনাথ ও ব্যক্তি লালন প্রমুখ। |
৬. এটি; কেবল আরববিশ্বে প্রতিষ্ঠিত মতবাদ। | ৬. এটি; সারাবিশ্বব্যাপী প্রতিষ্ঠিত মতবাদ। |
৭. এটি; কেবল অন্ধবিশ্বাসের ওপর প্রতিষ্ঠিত মতবাদ। | ৭. এটি; যুক্তি, দর্শন ও বিজ্ঞানের ওপর প্রতিষ্ঠিত মতবাদ। |
৮. এটি; দ্বারা ব্যাপক উগ্রবাদ ও সন্ত্রাসবাদ সৃষ্টি হয়। | ৮. এটি; দ্বারা অতি সামান্যই উগ্রবাদ ও সন্ত্রাসবাদ সৃষ্টি হয়। |
৯. এটি; অত্যন্ত দ্রুত সাম্প্রদায়িক মতবাদ রূপ লাভ করে। | ৯. এটি; অনেক বিলম্বে সাম্প্রদায়িক-মতবাদ রূপ লাভ করে। |
তবে বর্তমানকালের প্রচলিত অবতারবাদ ও ঐশিবাদের সংজ্ঞা ও বর্ণনা এমন নয়। প্রচলিত সংজ্ঞা ও বিবরণে বলা হয় স্রষ্টাই কোথাও মানুষ রূপে আবার কোথাও দেবতা রূপে অবতারিত হন।
প্রচলিত বর্ণনা ও সংজ্ঞাগুলো স্থূল দৃষ্টিসম্পন্ন গবেষক বা নীতিনির্ধারকগণের সূক্ষ্মজ্ঞানের অদূরদর্শিতা বা চরম দৈন্যতা বৈ নয়। কারণ; স্রষ্টা বলি কিংবা ব্রহ্মা বলি তিনি যদি জগতের সৃজকই হন; তবে সারাবিশ্বই তার নিকট সমান হওয়াই যুক্তিযুক্ত। তিনি কোথাও মানববেশে অবতরণ করবেন এবং কোথাও মানবের মধ্য হতে প্রতিনিধি বেছে নিয়ে তাঁর ঐশিবাণী বা দৈববাণী প্রচার করবেন এটা যুক্তিসঙ্গত হতে পারে না। এসব ঠুনকো বা খোঁড়া মতবাদ যদি আমরা মেনে নিই তবে স্রষ্টার দ্বৈতশাসন বা দ্বৈতপালন প্রায়ই প্রকাশ পায়। বিশ্বের স্রষ্টা একজন হলে তাঁর নীতিও একটি হওয়া উচিত। তবে; যদি কেউ ইচ্ছেমতো রূপক স্রষ্টা নির্মাণ করে তার দ্বারা ভিন্ন ভিন্ন শাসনব্যবস্থার পৌরাণিক কাহিনী নির্মাণ করেন সেটি ভিন্ন কথা।
বিশ্বস্রষ্টার দ্বারা বিশ্বের কোথাও দ্বৈতশাসন বা দ্বিবিধ পালনপোষণের প্রক্রিয়া এখন পর্যন্ত কেউই প্রমাণ করতে পারেন নি। অনন্তকাল পর্যন্ত বিশ্বের সব মানুষ একত্র হয়ে প্রচেষ্টা করলেও এমন ব্যবধান অন্বেষণ করা সম্ভব নয়। এবার প্রশ্ন হতে পারে যে; তবে ভারতীয় শ্বরবিজ্ঞানে; প্রতিনিয়তই দেবতা রূপে ব্রহ্মার অবতরণ দেখতে পাওয়া যায়; অন্যদিকে; পারসিক পুরাণে অসংখ্য মানবরূপী ঐশিপ্রতিনিধি দেখতে পাওয়া যায়! এমন হওয়ার কারণ কী? উত্তর হলো; দেবতাগণ হলেন; ‘মানুষে বিদ্যমান বিষয়বস্তু ও ইন্দ্রিয়াদি এর রূপক নামে” দেবতায়িত ‘বাঙালী পৌরাণিক চরিত্র’। অন্যদিকে; ঐশিদূতগণ হলেন; ‘মানুষে বিদ্যমান বিষয়বস্তু ও ইন্দ্রিয়াদি এর রূপক নামে” দেবতায়িত ‘আরবীয় পৌরাণিক চরিত্র’। রূপকারগণের নির্মাণশৈলীর ভিন্নতা ও পুরাণ নির্মাণ কৌশলের ভিন্নতা দ্বারা বিশ্ববিধাতার পালনপোষণের ভিন্নতা প্রমাণিত হয় না। অদ্যাবধি আমরা মতবাদবিশ্বে ভারতবলয় ও আরববলয় রূপে দুটি বলয়ই মাত্র দেখতে পাই। ভারতবলয়ে অবতারবাদ এবং আরববলয়ে ঐশিবাদ। এসব গবেষক মনীষীগণের নিতান্ত নির্ণয় বলেই ভিন্নরূপ প্রতীয়মান হয়। যেমন; লালন সাঁইজি বলেছেন; “১কী কালাম পাঠালেন আমার, সাঁই দয়াময়, একেক দেশে একেক বাণী কয় খোদা পাঠায়। ২এক যুগে যা পাঠায় কালাম, অন্য যুগে হয় কেন হারাম, দেশে দেশে উপমা তামাম, ভিন্ন দেখা যায়। ৩যদি এক খোদার হয় বর্ণনা, তাতে তো ভিন্ন থাকে না, মনুষের সব রচনা, তাইতো; ভিন্ন হয়। ৪একেক দেশে একেক বাণী, পাঠান কী সাঁই গুণমনি, মানুষের রচিত জানি, লালন ফকির কয়।” (পবিত্র লালন- ৩০৫)।
আবার বলন তত্ত্বাবলীতে আমরা দেখতে পাই-
“কাঁইয়ের বাণী ভিন্ন নয়রে বিশ্ব চরাচরে,
মতবাদে মতবাদে এ ভেদাভেদ মানুষে সৃষ্টি করে।
সাম্প্রদায়িক গ্রন্থ বুঝের ভুলে ভুলব্যাখ্যা করে রচনা,
ভুলে জন্ম ভুলেই মরণ সঠিক ব্যাখ্যা বুঝে না,
কেউ সঠিক বুঝ কইলে,
লোকে তারে পাগল বলে,
সত্যকে দেয় রসাতলে,
পণ্ডিতরা যুক্তি করে।
অভিধার শব্দ ভেদটা অন্বেষণ করে দেখ মনা,
চোখ থাকতে রইলি অন্ধ মতবাদ-তত্ত্ব বুঝলি না,
মতবাদ বাণী অলৌকিক ভেবে,
অনুমানে সাধন সেধে,
সারাজনম গেলি কেঁদে,
মনা সত্যতা রেখে দূরে।
প্রকৃতিনীতিই কাঁইয়ের বাণী অবলোকন করলি না,
সাম্প্রদায়িক গ্রন্থে তাই যে লেখা একবার ভেবে দেখলি না,
আত্মা ইন্দ্রিয় মন জ্ঞান,
সাম্প্রদায়িক মতবাদ নির্মাণের উপকরণ,
বিনয়ে কয় কাঁইজি বলন,
অন্বেষণ করো আপন ধড়ে।”
বিদ্রোহী কবি কাজি নররুল ইসলাম লিখেছেন;
“পুঁজিছে গ্রন্থ ভণ্ডের দল, মুর্খরা সব শোন
মানুষ এনেছে গ্রন্থ, গ্রন্থ আনে নি মানুষ কোনো।”
আগামী কয়েক শতাব্দী পর সারাবিশ্বের মানুষের সাম্প্রদায়িক বিশ্বাসগুলো যে কত প্রকার হবে তা বলা কঠিন। পরিশেষে আমরা এ কথা বলতে চাই যে; জ্ঞানের সূক্ষ্মরাজ্যে প্রবেশ করলে দেখা যায়; আলোচ্য অবতারবাদ ও ঐশিবাদ উভয় মনীষীদের নির্মিত পরিভাষাগুলো ও সংজ্ঞাগুলোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ। প্রকৃতপক্ষে বিশ্ববিধাতা ঈশ্বর কিংবা প্রকৃত সত্যতা তাদের নির্মিত পরিভাষাগুলো ও সংজ্ঞাগুলোর অনেক অনেক ঊর্ধ্বে। অর্থাৎ; আলোচ্য অবতারবাদও মানুষের দ্বারা নির্মিত এবং ঐশিবাদও যুগে যুগে মানুষের দ্বারাই নির্মিত। প্রকৃত বিশ্ববিধাতার সাথে এসবের কোনো মিল নেই। এজন্য; বলা যায় এমন ঠুনকো ও খোঁড়া সংজ্ঞাগুলো বা পরিভাষাগুলো দ্বারা সাম্প্রদায়িক বিদ্যাও জানা সম্ভব নয়- শ্বরবিজ্ঞান বা পরাবিদ্যা তো আরও ব্যবধানের কথা।
প্রকৃত-জ্ঞান বা সূক্ষ্মজ্ঞানের অদূরদর্শিতা ও দৈন্যতা হেতু মানুষের নির্মিত বা মানুষের নির্মিত রূপকথার উপাখ্যানগুলো, রূপক উপমাদি, পৌরাণিক সাহিত্যাদি এবং সংজ্ঞা ও পরিভাষাগুলো বা মানুষের করণ কারণ বিশ্ববিধাতার ওপর চাপিয়ে দিয়ে নিজেদের পিঠ বাঁচানো, নিজেদের বড়ত্ব প্রমাণ করা, জ্ঞানের খুষ্কতা ও জ্ঞানের দৈন্যতা বৈ কিছু নয়। আরও একটি কারণ উল্লেখ করা যায়- মানুষ মানুষের প্রয়োজনে নির্মিত এসব রূপকথার উপাখ্যানগুলো, রূপক উপমাদি, পৌরাণিক সাহিত্যাদি এবং সংজ্ঞা ও পরিভাষাগুলো দ্বারা যুগে যুগে মানুষ মানুষকে বিপদের সম্মুখীন করে যাচ্ছে প্রতিনিয়তই। একদল এসবের দ্বারা আর্থিকভাবে উপকৃত হচ্ছে আবার অন্যদল এর দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
সরাসরি স্বর্গীয় অবতার ও স্বর্গীয় প্রতিনিধি নির্মাণের সূত্রাবলী
(The construction formula of the directly seraphim and celestial representatives)
বাংভারতীয় স্বর্গীয় অবতার ও আরবীয় ঐশি প্রতিনিধি সবই সুনিপুণ ও সুবিজ্ঞ রূপকারগণের দ্বারা নির্মিত। নিচে স্বর্গীয় অবতার বা স্বর্গীয় প্রতিনিধি নির্মাণের সূত্রগুলো তুলে ধরা হলো।
১. ‘বাঙালী পৌরাণিক চরিত্রায়ন সত্তা সারণী’তে বর্ণিত ‘বাঙালী পৌরাণিক মূলক সত্তা’র বিষয়বস্তু, শক্তি, স্থান, কাল ও অবস্থা ইত্যাদির মধ্যে যে কোনো একটিকে বেছে নিতে হবে।
২. ‘বাঙালী পৌরাণিক চরিত্রায়ন সত্তা সারণী’তে বর্ণিত যে কোনো ‘বাঙালী পৌরাণিক মূলক সত্তা’র অশ্রুতপূর্ব রূপক সৃষ্টি করতে হবে।
৩. ‘পৌরাণিক সংখ্যা সূত্র’ গুলোর সাহায্যে একটি উপমামূলক রূপক জীবনী নির্মাণ করতে হবে।
৪. দৈবসত্তাগুলো ও ‘পৌরাণিক সংখ্যা সূত্র’গুলোর সাহায্যে সভ্যতার সপ্তযুগের (১. শক্তিযুগ ২. পদার্থ যুগ ৩. প্রস্তর যুগ ৪. ধাতু যুগ ৫. আদিম যুগ ৬. মধ্য যুগ ও ৭. আধুনিক যুগ) প্রথম পঞ্চযুগ অর্থাৎ; ১. শক্তি যুগ ২. পদার্থ যুগ ৩. প্রস্তর যুগ ৪. ধাতু যুগ ৫. আদিম যুগ; এ পঞ্চযুগের সীমারেখার মধ্যে থেকে যুদ্ধগুলো, বনবাস, দিপান্তর, ভ্রমণ বা পর্যটন ইত্যাদির ওপর পুরাণ নির্মাণ করতে হবে।
সতর্কতা (Alertness)
১. সুবিজ্ঞ রূপকার বা সুবিজ্ঞ প্রপকার ব্যতীত সাধারণ কবি ও সাহিত্যিকগণের এ কাজটিতে হাত দেওয়া একেবারে উচিত নয়।
২. পাকা আত্মজ্ঞানী কিংবা সুবিজ্ঞ আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্ব ব্যতীত সাধারণ গবেষক ও চিন্তবিদগণের এ কাজটি করা কোনো ক্রমেই উচিত নয়।
নিচে মহামানব ঠিক করতে হবে
নির্মিত মহামানবকে পৌরাণিক মহামানব করতে হবে
মহামানব (Philanthropist)
সাধারণত; ঈশ্বর কুলে উন্নীত শ্রেষ্ঠ জনহিতৈষী ব্যক্তিকে মহামানব বলা হয়। তবে; সাম্প্রদায়িক ও পারম্পরিক মনীষীদের মতে; সাম্প্রদায়িক ও আধ্যাত্মিক বিদ্যায় বিশেষ ব্যুৎপত্তিলাভকারী মহান ব্যক্তিকে মহামানব বলা হয়।
মহামানবের সংজ্ঞা (Definition of philanthropist)
বাঙালী শ্বরবিজ্ঞানে ও বাঙালী পুরাণে; ব্রহ্মবিদ্যায় বিশেষ ব্যুৎপত্তিলাভকারী ঈশ্বর কুলে উন্নীত শ্রেষ্ঠ জনহিতৈষী ব্যক্তিকে মহামানব বলে। যেমন; লালন।
মহামানবের প্রকারভেদ (Variations of philanthropist)
বাঙালী শ্বরবিজ্ঞানে ও বাঙালী পুরাণে মহামানব দুই প্রকার। যথা; ১. বাস্তব মহামানব ও ২. নির্মিত মহামানব।
১. বাস্তব মহামানব (Real philanthropist)
যে মহান মনীষীগণ কর্মজীবনে স্বস্ব সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক নাম, বসতি ও পরিচয় অক্ষুন্ন রেখে জনহিতৈষী কার্যাদি, কাব্যগুলো বা সাহিত্যাদি নির্মাণ করে স্ব-নামে বিশ্ববাসীর হৃদয়গ্রাহিতা অর্জন করেন তাকে বাস্তব মহামানব বলে। যেমন; কবি রবিন্দ্রনাথ ঠাকুর, কবি নজরুল ইসলাম, মাদার তেরেসা, অমর্ত্য সেন ও ডঃ মুহাম্মদ ইউনুস প্রমুখ সুমহান ব্যক্তিত্ব।
বাস্তব মহামানবের সংজ্ঞা (Definition of real philanthropist)
সাধারণত; যে মহান মনীষীগণ কর্মজীবনে স্বস্ব সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক নাম, বসতি ও পরিচয় অক্ষুন্ন রেখে মানব-হিতৈষী কার্যাদি, কাব্যগুলো বা সাহিত্যাদি নির্মাণ করে স্ব-নামে বিশ্ববাসীর হৃদয়গ্রাহিতা অর্জন করে থাকেন তাকে বাস্তব মহামানব বলে। যেমন; মাদার তেরেসা।
বাস্তব মহামানবের পরিচয় (Identity of real philanthropist)
বাস্তব মহামানব বলতে কাব্য-সত্তা বা লেখ্যকীর্তির দ্বারা বিশ্ববাসীর চিত্তপটে চির ভাস্বর হয়ে থাকা কবি, সাহিত্যিক, দার্শনিক ও বৈজ্ঞানিকগণকে বুঝায়। তাঁরা সারাটি জীবন নতুন নতুন পরিভাষা সৃষ্টি করে নতুন নতুন অনুপম কাব্য ও সাহিত্যাদি সৃষ্টি করে বিশ্ববাসীকে তা উপহার দিয়ে যান। এমন মহান ব্যক্তিবর্গের নিকট আমরা চির ঋণী। তাঁদের অমূল্য রচনাবলী ভাষার সম্পদ ও দেশের সম্পদ। এমন মহামানবগণের নিকট আমরা চির কৃতজ্ঞ। কয়েকজন বাস্তব মহামানবের নির্ঘণ্ট হলো; ১.বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ২.বাংলাদেশের জাতীয়কবি নজরুল ইসলাম ৩.ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ৪.মাইকেল মধসুদন দত্ত ৫.শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ৬.ফররুক আহমদ ৭.পল্লীকবি জসিম উদ্দিন ৮.বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবর রহমান ও ৯.নবাব সিরাজদ্দৌলা প্রমুখ।
বাস্তব ও নির্মিত মহামানবের পার্থক্য
(Difference between real and created philanthropist)
বাস্তব মহামানব | নির্মিতি মহামানব |
১. যে মহান মনীষীগণ কর্মজীবনে স্বস্ব সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক নাম, বসতি ও পরিচয় অক্ষুন্ন রেখে মানব-হিতৈষী কার্যাদি, সাহিত্যাদি রচনা করে স্ব-নামে বিশ্ববাসীর হৃদয়গ্রাহিতা অর্জন করেন তাকে বাস্তব মহামানব বলে। যেমন; মাদার তেরেসা। | ১. যে কোনো কাব্যের যে ‘পৌরাণিক মানবায়িত চরিত্র’ ক্রমে ক্রমে মহামানব রূপে বিশ্ববাসীর হৃদয় গ্রাহিতা অর্জন করতে সক্ষম হয় তাকে পৌরাণিক মহামানব বলে। যেমন; রামায়ণের রাম, মহাভারতের কৃষ্ণ এবং কুরানের মুহাম্মদ প্রমুখ। |
২. এঁদের নাম, বংশ ও বসতির কোনো পরিবর্তন হয় না। | ২. এঁদের নাম, বংশ ও বসতি সম্পূর্ণ রূপকার্থে নির্মিত। |
বাস্তব মহামানব | নির্মিতি মহামানব |
৩. এঁদের নাম, জন্মস্থান ও সামাজিক পরিচয় অবিকল পাওয়া যায়। | ৩. এঁদের নাম, জন্মস্থান ও সামাজিক পরিচয় অবিকল পাওয়া যায় না। |
৪. এঁদের সত্তা ৩টি; ১.ব্যক্তি-সত্তা ২.কাব্য-সত্তা ও ৩.লৌকিক সত্তা। | ৪. এঁদের সত্তা ৩টি; ১. কাব্য-সত্তা ২. লৌকিক সত্তা ও ৩. দৈবসত্তা। |
৫. এঁদের জন্ম ও প্রয়াণ রয়েছে। | ৫. এঁদের জন্ম ও প্রয়াণ নেই। |
৬. এঁরা প্রত্যেকেই বাস্তব মানুষ। | ৬. এঁরা প্রত্যেকেই দেবতা। |
৭. এঁরা যোনিজাত। | ৭. এঁরা অযোনিজাত। |
৮. এঁরা অলৌকিক। | ৮. এঁরা লৌকিক। |
৯. এঁদেরকে বিশ্বের সব জীবের মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায় না। | ৯. এঁদেরকে বিশ্বের সব জীবের মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায়। |
১০. এঁরা অ, ﺍ, অ ইত্যাদি বর্ণমালার দ্বারা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত। | ১০. এঁরা বর্ণমালার দ্বারা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত নন বরং এঁরা দৈবজ্ঞানে জ্ঞানী। |
১১. এঁদের ভজন-সাধনের বাস্তবতা পাওয়া যায় না। যেমন; কবির কাব্যগুলো ভিন্ন ব্যক্তির অস্তিত্বের কোনো প্রমাণ নেই। | ১১. এঁদের সাধন ভজনের বাস্তবতা পাওয়া যায়। যেমন; কাঁই ও সাঁই ইত্যাদির অস্তিত্বও রয়েছে এবং তাদের সাধন ভজনও রয়েছে। |
২. নির্মিত মহামানব (Created philanthropist)
বিশিষ্ট কোনো সাহিত্যিকের দ্বারা বা বিশিষ্ট কোনো কবির দ্বারা নির্মিত যেসব সাহিত্য বা কাব্যের কেন্দ্রীয় নায়ক নায়িকার চরিত্রগুলো মহামানবীয় চরিত্র রূপে ক্রমে ক্রমে বিশ্ববাসীর হৃদয়গ্রাহিতা অর্জন করে তাকে নির্মিত মহামানব বলে। যেমন; রামায়ণের রাম, গীতার শ্রীকৃষ্ণ এবং কুরানের মুহাম্মদ ইত্যাদি। বাস্তব মহামানব বা মনীষীগণের স্ব-নামে অসংখ্য গুণকীর্তন প্রকাশিত হয়। তাঁদের সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক নাম, বংশ, আবাস, কর্মজীবন ও কর্মক্ষেত্র ইত্যাদির ঐতিহাসিক প্রমাণ পাওয়া যায়। কিন্তু নির্মিত মহামানব বা মহামনীষীগণের লৌকিক সত্তাগুলো ব্যতীত কিছুই পাওয়া যায় না। তাদের সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক নাম, বংশ, আবাস, কর্মজীবন ও কর্মক্ষেত্র ইত্যাদির ব্যাপারে অসংখ্য লৌকিক সত্তাগুলো পাওয়া যায় কিন্তু ঐতিহাসিক বা প্রত্নতাত্ত্বিক কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না। তাদের সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক নাম, বংশ, আবাস, কর্মজীবন ও কর্মক্ষেত্র ইত্যাদির যে পরিচয় পাওয়া যায়, তা পুরোটাই সুবিজ্ঞ রূপকার বা প্রপকারগণের দ্বারা রূপকার্থে নির্মিত।
নির্মিত মহামানবের সংজ্ঞা (Definition of created philanthropist)
সাধারণত; যে কোনো কাব্যের যে ‘পৌরাণিক মানবায়িত চরিত্র’ ক্রমে ক্রমে মহামানব রূপে বিশ্ববাসীর হৃদয় গ্রাহিতা অর্জন করতে সক্ষম হয় তাকে পৌরাণিক মহামানব বলে। যেমন; রামায়ণের রাম, মহাভারতের কৃষ্ণ এবং কুরানের মুহাম্মদ প্রমুখ।
নির্মিত মহামানবের পরিচয় (Identity of created philanthropist)
নির্মিত মহামানব বলতে কবি, মরমীকবি বা পৌরাণিক সাহিত্যিকগণের মনের মাধুরীতে আঁকা একান্ত কল্পিত এমন কেন্দ্রীয় চরিত্রগুলো বুঝায়- যা ক্রমে ক্রমে বিশ্বজনীনরূপলাভ করে। যেমন; আদিকাব্য রামায়ণের প্রধান চরিত্র ‘রাম’ এবং পবিত্র কুরানের প্রধান চরিত্র ‘মুহাম্মদ’। নির্মিত এ মহামানবগণের চরিত্র গগনচুম্বী ও বিশ্বজনীন করার জন্য অসংখ্য লৌকিক সত্তা নির্মাণ করা হয়। লৌকিক সত্তাগুলোর গঠন উপাদানাদি না জেনে সাধারণ মানুষ নির্মিত মহামানবগণের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হতে থাকে। প্রপক বা লৌকিক সত্তাগুলোর ওপর নির্ভর করে এক সময় তার জন্ম পরম্পরা, বংশ ও আবাসস্থল নির্ণয় করা হয়। এসবের ওপর আরও প্রপক নির্মাণ করা হয়। পরিশেষে তাঁদের সমাধিও চিহ্নিত করা হয়। কোনো কোনো সময় নির্মিত মহামানবগণেরও জলজ্যন্ত এমন সব ব্যাস্তবতা প্রতিষ্ঠালাভ করে যে; তা আর নির্মিত বলার উপায় থাকে না কারো। একবার যদি এঁরা উপাস্যের পর্যায়ে উন্নীত হন তবে বিশ্বের কোনো শক্তি দ্বারাই তা নির্মিত বলে প্রমাণ করার উপায় থাকে না। যেমন; রামায়ণে বর্ণিত রাম, গীতাক্তো কৃষ্ণ এবং কুরানে বর্ণিত মুহাম্মদ। নিচে নির্মিত মহামানবের নির্ঘণ্ট দেওয়া হলো; ১.বেদব্যাস ২.বুদ্ধ ৩.অহল্যা ৪.লোকনাথ ব্রহ্মচারী ৫.লালন সাঁইজি ৬. বলন কাঁইজি ও ৭.মোহন্ত।
সাঁইকে সর্বশেষ অবতার বলার কারণ কী?
(What cause to say God the latest incarnation?)
নরদেহকে বলা হয় অর্ধাঙ্গ এবং নারীদেহকে বলা হয় অর্ধাঙ্গী। আধা অঙ্গ ও আধা অঙ্গ মিলেই একদেহ বা পূর্ণাঙ্গ মানুষ হয়। বিশ্বের পারম্পরিক মনীষীগণের মতে; সাঁই নারীদেহের সর্বশেষ অবতার। নারীদেহ নিয়ে আলোচনা করলে সাধারণ পাঠককুল বা শ্রোতামণ্ডলী মন্দ বলতে পারে। এজন্য; আত্মজ্ঞানীগণ সাধারণত; মানবদেহকে সম্বোধন করেই ‘বাঙালী পৌরাণিক চরিত্রায়ন সত্তা সারণী’তে বর্ণিত ‘বাঙালী পৌরাণিক মূলক সত্তা’র আলোচনা উপস্থাপন করে থাকেন। সাঁই রমণী দেহের সর্বশেষ অবতার। এজন্য; এখানে; নারীদেহ নিয়ে আলোচনা করা ভিন্ন অন্য কোনো উপায় নেই। সমীক্ষার জন্য আমরা একটি কন্যাসন্তান নিয়ে আলোচনা উপস্থাপন করতে চাই। কন্যাসন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর সর্বপ্রথমে তার নাসিকাযোগে শ্বসন ক্রিয়া আরম্ভ হয়। তারপর; সক্রিয় হয় মন। অতঃপর; যখন ক্ষুধা অনুভব করে পান-ভোজনের জন্য সক্রিয় হয় মুখ। কিন্তু তখনও তার অন্যান্য ইন্দ্রিয়াদি সচল হয় না। ইন্দ্রিয়াদি সচল হওয়া বলতে ইন্দ্রিয়াদির সার্থক ব্যবহার করা বুঝানো হয়েছে।
অতঃপর; পর্যাক্রমে কন্যাশিশুটি কান দ্বারা শোনে, চোখ দ্বারা দেখে ও হাত দ্বারা কোনকিছু ধরা আরম্ভ করে। প্রায় ছয়মাস হতে একবছর বয়সে তার প্রথম দুধের দাঁত উদ্গত হয়। শ্বরবিজ্ঞানে; এভাবে ইন্দ্রিয়াদি সক্রিয় হওয়াকে একেকটি ঐশি দেবতার অবতরণ করা বলা হয়। এক হতে দুই বছরের মধ্যে শিশুটির পা ক্রমে ক্রমে সচল হতে থাকে। তখন সে একপা দুপা করে হাঁটতে আরম্ভ করে। ক্রমে ক্রমে দেহটিও সুগঠিত হতে থাকে। অতঃপর; ৪ হতে ৭ বছর বয়সের মধ্যে দুধের দাঁতগুলো ক্রমে ক্রমে পড়ে গিয়ে ভাতের দাঁত উদ্গত হয়। ১০ হতে ১২ বছর বয়সের মধ্যে তার কোটিদেশও মোটাসোটা হতে থাকে। সাথে সাথে তার বুকের মাংসপেশী স্ফীত হয়ে স্তন আকারে প্রকাশিত হতে থাকে।
দেহের বাহ্যিক সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সুগঠিত হওয়ার পর কোনো এক শুভক্ষণে স্বর্গীয় অবতার সরস্বতী (রজ) দেবীর আগমন হয়। হিন্দু রূপকার মনীষীগণ রজকে সরস্বতী এবং মুসলমান রূপকার মনীষীরা রজকে হাওয়া (ﺤﻮﺍﺀ) বলে অভিহিত করে থাকেন। এ রজই বিশ্বের সর্বপ্রকার শ্বরবিজ্ঞানের আদিমাতা। আবার এ রজকেই রূপক চরিত্রাকারে হিন্দুরা নারদ, মুসলমানরা আরবি ভাষায় নবি (ﻨﺑﻰ) এবং ফার্সি ভাষায় পয়গাম্বর (ﭙﻴﻐﻤﺒﺮ) বলে থাকে। বাংলা ভাষায় একে বসিধ বলা হয়। এ ঐশি দেবতা আগমন করে কৈশোরকালকে হত্যা করে কিশোরীকে যুবতীতে পরিণত করে থাকে। যারফলে; রমণীদের শুভ যৌবনকাল আরম্ভ হয়। উপরোক্ত আলোচনা হতে বাহ্যিকভাবে দেখা যায় রমণীদেহে বসিধই সর্বশেষ ঐশি দেবতা। এটি;ই মুসলমান ঘরানার সর্বসম্মত অভিমত। এটাই মুসলমানদের সর্বশেষ স্তর। স্থূলভাবে আবার অনেকে এটাকে শরিয়তের সর্বশেষস্তরও বলে থাকেন। এ বসিধের বক্তব্য হলো; “ﺍﻨﺎ ﺨﺎﺘﻡ ﺍﻟﻨﺒﻰ ﻮ ﻻ ﻨﺒﻰ ﺒﻌﺿﻰ” উচ্চারণ; “আনা খাতামান নাবি ওয়া লা নাবিয়া বাদি” অর্থ; “আমিই সর্বশেষ বসিধ এবং আমার পরে কোনো বসিধ নেই।” বিষয়টি আরও স্পষ্ট করে বললে বলতে হয় “ﻘﺎﻞ ﺍﻟﺤﻴﺾ ﺍﻨﺎ ﺨﺎﺗﻢ ﺍﻟﻨﺒﻰ ﻟﺠﺴﻢ ﺍﻟﻨﺴﺎﺀ ﻮ ﻻ ﻨﺒﻰ ﺒﻌﺿﻰ” উচ্চারণ; “কালাল হায়িজু আনা খাতামান নাবি লিজিসমিন নিসায়ি, ওয়া লা নাবিয়া বাদি” অর্থ; “রজ বলে যে; আমি নারীদেহে সর্বশেষে বসিধ এবং আমার পরে কোনো বসিধ নেই।” আরও বিস্তারিত জানার জন্য অত্র গ্রন্থের ৭ম খণ্ডের ঘোষক২ শিরোনাম পড়ে দেখুন।
পক্ষান্তরে; দেহতাত্ত্বিক, আত্মজ্ঞানী ও পারম্পরিক মহান মনীষীগণ বসিধকে সর্বশেষ স্বর্গীয় অবতার বলে কখনই স্বীকার করেন না। তাঁরা বলেন যে; বসিধ সাম্প্রদায়িক ও পারম্পরিকদের সর্বশেষ দেবতা হতে পারেন কিন্তু আত্মজ্ঞানীগণের সর্বশেষ স্বর্গীয় অবতার হলেন সাঁই। কারণ; বসিধ এসে, যার আগমনের সুসংবাদ প্রদান করেন তিনিই হলেন সাঁই। তাঁরা আরও বলেন বসিধ একজন স্বর্গীয় সাংবাদিক। তিনি কারো সংবাদ বহন করে না আনলে, তাঁকে সাংবাদিক বলাও অনর্থক বৈ নয়। তাঁদের মতে; বসিধ আগমন করে তিনদিন অবস্থানের পর তার নির্গমন করার পরবর্তী প্রহরেই সাঁই আগমন করে থাকেন। পবিত্র কুরানে বলা হয়েছে- “ وَإِذْ أَخَذَ اللَّهُ مِيثَاقَ النَّبِيِّينَ لَمَا آتَيْتُكُمْ مِنْ كِتَابٍ وَحِكْمَةٍ ثُمَّ جَاءَكُمْ رَسُولٌ مُصَدِّقٌ لِمَا مَعَكُمْ لَتُؤْمِنُنَّ بِهِ وَلَتَنْصُرُنَّهُ ” অর্থ; আর কাঁই যখন বসিধগণের কাছ থেকে অঙ্গিকার গ্রহণ করলেন, আমি যা কিছু তোমাদের দান করেছি গ্রন্থ ও জ্ঞান; অত:পর তোমাদের নিকট কোনো সাঁই আসেন তোমাদের গ্রন্থকে সত্য বলে দেয়ার জন্য, তখন তাঁর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন ও তাঁর সাহায্য করবে। “And when Lord took the covenant of the prophets, saying: “Take whatever I gave you from the book and wisdom, and afterwards there will come to you a messenger confirming what is with you; you must, then, believe in him and help him.” “(কুরান, ইমরান- ৮১)। উল্লেখ্য যে; কাঁই সবার আগে অবতরণ করেন। সেজনই তো কাঁইকে আদি বা অগ্রজ বলা হয়। চরম বাস্তবতা হলো মানবদেহে সর্বশেষে আগমনকারী তিনজন দেবতার মধ্যে কাঁই সবার আগে অবতরণ করেন, তারপর; বসিধ অবতরণ করেন। অতঃপর; সর্বশেষে সাঁই অবতরণ করে থাকেন। এ হতেই সারাবিশ্বের আত্মজ্ঞানী মনীষীগণ সাঁইকে সর্বশেষ অবতার বলে থাকেন। পরিশেষে বলা যায় বসিধ হলেন সাম্প্রদায়িক ও পারম্পরিকদের সর্বশেষ স্বর্গীয় অবতার কিন্তু সাঁই হলেন আত্মজ্ঞানীগণের সর্বশেষ স্বর্গীয় অবতার।
সৃষ্টিকর্তা কে কাঁই নাকি সাঁই? (Who is creator? Lord or God?)
বাংলাভাষা সৃষ্টি হওয়ার বয়স প্রায় পনেরো শত (১,৫০০) বছর। বর্তমান পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে বসবাসকারী বাংলা ভাষাভাষী লোকসংখ্যাও প্রায় পঞ্চাশ কোটি (৫০,০০,০০,০০০)। বিশ্বাঙ্গনে ব্যবহারের দিক দিয়ে বাংলাভাষার স্থান ৬ষ্ঠতম। বাংলাভাষায় এ যাবৎ অনেক গীতি, কাব্য, কবিতা, নাটক, উপন্যাস, সারি, বৈঠকারী ও যাত্রাপালা ইত্যাদি রচত ও নির্মিত হয়েছে। এসব লেখনির মধ্যে অনেক বিষয়বস্তুর নাম পরিচয় দেখা গেলেও আজ বাংলাভাষায় সৃষ্টিকর্তার নাম দেখা যায় নি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে কেউ কেউ সৃষ্টিকর্তাকে স্রষ্টা বলে থাকেন এর অধিক নয়। এবার কেউ কেউ বলতে পারেন সৃষ্টিকর্তা তো সৃষ্টিকর্তাই তাঁর আবার নতুন নাম রাখার কিবা প্রয়োজন? এমন প্রশ্নের উত্তর হলো; ছেলে তো ছেলেই এবং মেয়ে তো মেয়েই। ছেলেমেয়ের আবার নতুন করে নাম রাখার কিসের প্রয়োজন? ব্যাপার হলো ছেলেমেয়ে জন্মগ্রহণের পর তাঁকে নির্দিষ্ট করার জন্যই তার নতুন একটি নাম রাখা একান্ত প্রয়োজন। বিশ্বের সব ছেলেই তো ছেলে এবং সব মেয়েই তো মেয়ে। তাদের ভিন্ন ভিন্ন নাম রাখা না রাখলে, শতশত ছেলেমেয়ের মধ্যে একজনকে ডেকে বের করবে কিভাবে? তেমনই; সৃষ্টিকর্তা বা স্রষ্টার ভিন্ন একটি নাম না রাখলে মানুষজন তাঁর উপাসনা বা জপ-তপ করবেন কিভাবে? স্রষ্টার উপাসনা করার জন্যই মানুষ স্রষ্টার বিভিন্ন নামকরণ করেছেন। স্রষ্টা মানুষের নামকরণ করে নি বরং মানুষই স্রষ্টার নামকরণ করেছেন। অর্থাৎ; স্রষ্টা নিজেই নিজের নামকরণ করেন নি বরং মানুষই স্রষ্টার নামকরণ করেছেন। যেমন; সংস্কৃত ভাষায় সৃষ্টিকর্তার নাম ‘ব্রহ্মা’ ইংরেজি ভাষায় Lord; আরবি ভাষায় ‘আল্লাহ (ﺍﻠﻠﻪ)’ ফার্সি ভাষায় ‘খোদা (ﺨﺪﺍ)’ ইত্যাদি। অন্যান্য ভাষায় সৃষ্টিকর্তার নামকরণ করা হলে বাংলাভাষায় থাকবে না কেন? আবার সংস্কৃত ভাষায় পালনকর্তার নাম ‘বিষ্ণু’ ইংরেজি ভাষায় God আরবি ভাষায় ‘رب’ (রাব্বা) বা ‘মুরাব্ব (ﻤﺮﺐ)’ ফার্সি ভাষায় ‘খোদা (ﺨﺪﺍ)’ ও বার্মিস ভাষায় ‘ওঁরাও’ ইত্যাদি।
পৃথিবীর সব ভাষার সৃষ্টিকর্তা ও পালনকর্তার নাম জানা নেই। তবে; সংস্কৃত, ইংরেজি, আরবি, ফার্সি, বার্মিস ও তুর্কিভাষার সৃষ্টিকর্তা ও পালনকর্তার নাম সম্পর্কে সামান্য হলেও জ্ঞানবোধ আছে বৈকি। এ ছয়টি ভাষার মধ্যে সংস্কৃত, ইংরেজি, আরবি ও বার্মিস ভাষার সৃষ্টিকর্তার নাম যথাক্রমে ‘ব্রহ্মা’, Lord, ‘আল্লাহ (ﺍﻠﻠﻪ)’ ও ‘খোদা (ﺨﺪﺍ)’ এবং পালনকর্তার নাম যথাক্রমে ‘বিষ্ণু’, God, ‘মুরাব্ব (ﻤﺮﺐ)’, ‘খোদা (ﺨﺪﺍ)’ ও ‘ওঁরাও’। এবার বলা যায় সাংস্কৃতিকদের সৃষ্টিকর্তার নাম ‘ব্রহ্মা’ ইংরেজদের Creator এর নাম Lord ও আরবদের খালেক্ব (ﺨﺎﻠﻖ) এর নাম ‘আল্লাহ (ﺍﻠﻠﻪ)’। আবার সাংস্কৃতিকদের পালনকর্তার নাম ‘বিষ্ণু’ ইংরেজদের guardian এর নাম God ও আরবদের মুরাব্ব (ﻤﺮﺐ) এর নাম ‘রব (ﺮﺐ)’। কিন্তু ফার্সিভাষার ক্ষেত্রে দেখা যায় সৃষ্টিকর্তা ও পালনকর্তার নাম মাত্র একটি, তা হলো ‘খোদা (ﺨﺪﺍ)’ এবং বাংলাভাষার ক্ষেত্রে দেখা যায় সৃষ্টিকর্তা ও পালনকর্তার নাম মাত্র একটি তা হলো ‘সাঁই’।
বাংলাভাষায় বলা হয় “সবার ওপরে সাঁই তার ওপরে নাই।” তেমনই; ফার্সি ভাষাতেও “সবার ওপরে ‘খোদা (ﺨﺪﺍ)’ তার ওপর নাই কেউবা।” এজন্য; বাংলাভাষায় কেবল ‘সাঁই’ পরিভাষাটি দ্বারা সৃষ্টিকর্তা ও পালনকর্তা উভয় সত্তাই এবং ফার্সিভাষায় কেবল ‘খোদা (ﺨﺪﺍ)’ পরিভাষাটি দ্বারা সৃষ্টিকর্তা ও পালনকর্তা উভয় সত্তাই বুঝানো হয়। ফার্সি ভাষায় ‘খোদা (ﺨﺪﺍ)’ সৃষ্টিকর্তা নাকি পালনকর্তা এটা তাদের একান্ত ব্যাপার। কিন্তু বাংলাভাষায় ‘সাঁই’ সৃষ্টিকর্তা- নাকি পালনকর্তা সত্তার ছদ্মনাম তা নির্ণয় করতে হতে পাঠককেই। কারণ; বর্তমানে বাংলাভাষার বয়স প্রায় ১,৫০০ বছর। এখনও এটি; করা না হলে আর হবে কবে?
বিশ্বের সব আত্মজ্ঞানী ও পারম্পরিক দার্শনিকদের মতে; সাঁই সর্বশেষ স্বর্গীয় অবতার যা আমরা পূর্বেই আলোচনা করেছি। এ হতে বলা যায় সর্বশেষে কেউ আগমন করলে তাঁর পূর্বে কোনো আগমনকারী অবশ্যই রয়েছে। আমরা পূর্ববর্তী শিরোনামে আলোচনা করেছি যে; সৃষ্টিক্রিয়ার অনুঘটক রূপে মানবদেহে সর্বশেষে আগমনকারী তিনজন ঐশি দেবতার মধ্যে সর্বাগ্রে অবতরণ করেন সৃষ্টিকর্তা, তারপর; বসিধ এবং সর্বশেষে আগমন করেন সাঁই। আরও দেখানো হয়েছে যে; বসিধ সৃষ্টিকর্তা ও পালনকর্তার সুসংবাদ বহনকারী। সৃষ্টিকর্তা জগৎসৃষ্টিকারী, বসিধ সংবাদদাতা এবং সাঁই জগৎ পালনকারী। যেহেতু; সাঁই সবার পরে আগমন করে গর্ভস্থ ভ্রূণ লালনপালনের দায়িত্ব পালন করে থাকেন সেহেতু সাঁইকে কখনই সৃষ্টিকর্তা বলা যায় না। এজন্য; অবশ্যই সাঁই পালনকর্তা।
উল্লেখ্য যে; মহাধীমান বলন কাঁইজিই সর্বপ্রথম বাংলাভাষার সৃষ্টিকর্তার নামকরণ করেন ‘কাঁই’। এর পূর্বে এদেশের সমস্ত লেখক, গবেষক, গীতিকার ও ঔপন্যাসিক ‘সাঁই’ পরিভাষাটিকে পালনকর্তা ও সৃষ্টিকর্তা উভয় রূপেই ব্যবহার করতেন। যেমন; মহাত্মা লালন সাঁইজি লিখেছেন; “অনন্তরূপ সৃষ্টি করলেন সাঁই, মানবের চেয়ে উত্তম কিছু নাই, দেব দেবতাগণ করে আরাধন, জনম নিতে এ মানবে” (পবিত্র লালন- ২২৭/২)। যেহেতু; এখন; সৃষ্টিকর্তার নাম নির্ধারণ হয়েছে। এজন্য; এখন চরণটি হবে- “অনন্তরূপ সৃষ্টি করলেন কাঁই, মানবের চেয়ে উত্তম কিছু নাই, দেব দেবতাগণ করে আরাধন, জন্ম নিতে এ মানবে।” যবনিকাপাতের পূর্বে বলা যায়; কাঁই মানুষের সৃষ্টিকর্তা, বসিধ মানুষের ঐশিদূত এবং সাঁই মানুষের পালনকর্তা। পূর্ববর্তী যেসব পুস্তক-পুস্তিকায় সাঁইকে সৃষ্টিকর্তা বলা হয়েছে তার সর্বস্থলেই সাঁইয়ের স্থলে কাঁই হবে। বাঙালী সৃষ্টিকর্তার নাম নির্ধারণ করা হলো বাংলা সাহিত্যের আরেকটি যুগান্তকারী সংস্কারও বটে। মহাধীমান বলন কাঁইজি সৃষ্টিকর্তার বাংলা নামকরণকারী রূপে সর্বকালে সর্বস্থলেই স্মরণীয় ও বরণীয় হয়ে থাকবেন চিরকাল।
লালন সাঁইজির সাঁইকে সৃষ্টিকর্তা বলার কারণ কী?
(Godship Lalon what cause to say God creator?)
১. “অনন্তরূপ সৃষ্টি করলেন সাঁই, মানবের চেয়ে উত্তম কিছু নাই, দেব-দেবতাগণ করে আরাধন, জন্ম নিতে এ মানবে।” (পবিত্র লালন- ২২৭/২)।
২. “কী অপরূপ বৃক্ষ, সৃষ্টি করলেন সাঁই জগতে, উল্টোবৃক্ষ করলেন সৃষ্টি, বারি নিজ কুদরতে।” (পবিত্র লালন- ২৯৮/১)।
৩. “ধরাকে সাঁই সৃষ্টি করে, আছে নিগমে বসে, কী দিব তুলনা তারে, তার তুলনা সে।” (পবিত্র লালন- ৫৬৫/১)।
৪. “বেদ পুরাণে হয় প্রচারি, যবনের সাঁই হিন্দুর হরি, তাও তো আমি বুঝতে নারী, দু’রূপ সৃষ্টি করলেন কী তার প্রমাণ।” (পবিত্র লালন- ৯১৯/৩)।
মহাত্মা লালন সাঁইজি যখন আবির্ভূত হয়েছিলেন তখন ভারতীয় উপমহাদেশে সৃষ্টিকর্তা ও পালনকর্তাকে বুঝানোর জন্য বাংলা শ্বরবিজ্ঞানে কেবল ‘সাঁই’ ভিন্ন অন্য কোনো পরিভাষা ছিল না। তাই; তখন সাধকরা বলতেন- “সবার ওপরে সাঁই তার ওপরে নাই।” সৃষ্টিকর্তাকে বুঝানোর জন্য ইংরেজিতে ‘লর্ড’ আরবিতে ‘আল্লাহ’ ফার্সিতে ‘খোদা’ ও সংস্কৃতিতে ‘ব্রহ্মা’ ইত্যাদি ‘বাঙালী পৌরাণিক রূপক পরিভাষা’ পাওয়া গেলেও দুই হাজার খ্রিস্টাব্দের পূর্বে বাংলা ভাষায় এমন কোনো পরিভাষা পাওয়া যায় নি। গত ২০০৮ ইং সালে বলন কাঁইজির ‘বলন তত্ত্বাবলী’ গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। এ গ্রন্থে সর্বপ্রথম ‘কাঁই’ পরিভাষার অস্তিত্ত্বের সন্ধান পাওয়া যায়। সৃষ্টিকর্তাকে বুঝানোর জন্য এ ‘কাঁই’ পরিভাষাটি স্বয়ং বলন কাঁইজির আবিষ্কার বলে জানা যায়। দীর্ঘদিন হতে বাংলা শ্বরবিজ্ঞানে সৃষ্টিকর্তার বাংলা নামের যে অভাব ছিল তা পুরণ হয়। এর পর হতে অন্যান্য লেখক ও গবেষকগণ সৃষ্টিকর্তার নাম রূপে কাঁই পরিভাষার ব্যবহার আরম্ভ করেন।
তাই এখন পরিষ্কারভাবে বলা যায় যে; তখন সৃষ্টিকর্তা ও পালনকর্তার জন্য ভিন্ন ভিন্ন ‘বাঙালী পৌরাণিক রূপক পরিভাষা’ না থাকার কারণে মহাত্মা লালন সাঁইজি সাঁইকে সৃষ্টিকর্তা বলে অভিহিত করেছিলেন। যেহেতু; এখন; সৃষ্টিকর্তার সুনির্দিষ্ট নাম ‘কাঁই’ রয়েছে। তাই; সৃষ্টিকর্তাকে এখন আর সাঁই বলা সমীচীন নয়। বরং এখন সৃষ্টিকর্তাকে ‘কাঁই’ ও পালনকর্তাকে ‘সাঁই’ বলাই অধিক বাঞ্ছনীয় হবে।
সুধা ও সাঁইয়ের মধ্যে পার্থক্য কী?
(What is the difference between nectar and God?)
ইতোমধ্যে মানবদেহে প্রায় পাঁচ হাজার প্রকারের অধিক পদার্থের সন্ধান মিলেছে। তারমধ্যে; কেবল রসই রয়েছে শতাধিক। সারাবিশ্বের সুমহান আত্মতাত্বিক মনীষীদের মতে; কেবল পাঁচটি রস সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। এখানে; আমরা কেবল সুধারসের আলোচনা করতে চাই। সব রস সব সময় নিঃসৃত হয় না। ঘর্ম নিঃসৃত হয় কেবল উত্তাপের সময়ে, আদি নিঃসৃত হয় কেবল সঙ্গমের সময়ে, শুক্র ও সুধারস নিঃসৃত হয় কেবল কামের সময়ে, দুগ্ধ নিঃসৃত হয় কেবলই গর্ভে সন্তান ধারণের পর এবং রক্ত নিঃসৃত হয় কেবল দেহ কাটা-চিরার পর।
সুধা নিঃসৃত হয় কেবল কামেয় সময়ে কিন্তু শুক্রপাত হলে তা আর কখনই স্বাধীষ্ঠানচক্রের বাইরে আনা সম্ভব হয় না। উল্লেখ্য যে; মৈথুনে শুক্রনিক্ষেপের পূর্ব পর্যন্ত সুধারস অমৃত বা অমির রূপেই অবস্থান করে কিন্তু শুক্রনিক্ষেপের পর যখন ডিম্বাণু নিষিক্ত করে তখন নিষিক্ত ডিম্বকোষকে কেন্দ্র করে তা একটি আবরণী বা থলে সৃষ্টি করে। অতঃপর; উক্ত অমৃতরস বা সুধারস সেই আবরণী থলের মধ্যে সঞ্চিত হতে থাকে। উক্ত থলির মধ্যে প্রবেশ করে অমৃত বা অমির যখন ভ্রূণ লালনপালনের দায়িত্ব পালন করা আরম্ভ করে তখনই তাঁকে আদি-পালনকর্তা বলা হয়। এ পালনকর্তাই হলেন সাঁই। বাঙালী পুরাণ মতে; বিষ্ণু, নারায়ণ, নিমাই ও নিরঞ্জন, খ্রিস্টানদের God (গড), আরবীয়দের ‘ﻤﺮﺸﺪ’ (মুর্শিদ), ‘ﺭﺴﻮﻞ’ (রাসুল), ‘ﺭﺐ’ (রব) ও ‘ﻤﺤﻤﺪ’ (মুহাম্মদ)। বিশ্বের সব পশু-পাখি, প্রাণী ও ফুলের জরায়ুতে ভ্রূণ লালনপালন করেন বলেই সাঁইকে বিশ্বের লালনপালনকর্তা বা সংক্ষেপে পালনকর্তা বলা হয়। মানুষের ক্ষেত্রে অবতরণকালে অমিরকে আহরণ না করলে এবং মানবভ্রূণ সৃষ্টি হয়ে গেলে, সে-ই অমৃতসুধা বা অমিরই সাঁইরূপ পালনকর্তায় রূপান্তরিত হয়ে যায়। তখন কোনো সাধন ছাড়াই দশমাস পর সন্তান প্রসবের সময়ে তাঁর দেখা মিলে। অর্থাৎ; সুধা মুক্ত মস্তিষ্ক মেরুজল কিন্তু সাঁই থলিতে আবদ্ধ জীবজল। সুধার মধ্যে সর্বপ্রকার পুষ্টি উপাদান বিদ্যমান থাকে কিন্তু সাঁইয়ের মধ্যে তা থাকে না। কচি ডাবের জলই ক্রমান্বয়ে গাঢ় হয়ে বিশালাকার ডাবগাছে রূপান্তরিত হয়। তখন যেমন; ঐ গাছটি পান ও ভক্ষণ করা যায় না; তেমনই; অমিরও যদি সাঁইয়ে রূপান্তরিত হয়; তবে তা-ও পান ও ভোজনের উপযোগী থাকে না।
মজার বিষয় হলো; বাংভারতের কিছু কিছু অজ্ঞ সাধক সুধা ও সাঁইয়ের মৌলিক পার্থক্য না বুঝে ও না জেনে সন্তান প্রসবের সময়ে দায়ের মাধ্যমে উক্ত বর্জ্যজল পান করে অমৃতপানের প্রচার করে থাকেন। এ ব্যাপারে মহাত্মা লালন সাঁইজি লিখেছেন; “যে ধনে উৎপত্তি প্রাণধন, সে ধনের হলো না যতন, অকালে ফল পাকায় লালন, দেখেশুনে জ্ঞান হলো না” (পবিত্র লালন- ৮২৮/৪)। অর্থ; যে শুক্রের প্রভাবে দেহকোষ সৃষ্টি হয় সে শুক্ররক্ষা করার জন্য মৈথুন প্রশিক্ষণ কেউ করেন না। যাঁরা একজন পাকা সাধকগুরুর নিকট দীক্ষাগ্রহণ করে সঠিকভাবে মৈথুন প্রশিক্ষণ করেন কেবল তাঁরাই সুধাকে সুধা রূপেই আহরণ করে তা পান করে ধন্য হতে পারেন। যেমন; কাঁঠাল গাছের কাঁঠাল ফল; তেমনই; মানুষ গাছের ফল মানব সন্তান। যেমন; উদ্ভিদকুলের ফল পাকলে ঝরে যায়; তেমনই; সন্তান রূপ মানব ফল পাকালেই তা প্রসব হয়। মানুষ গাছে সন্তান রূপ ফল ধরে এবং তা পাকতে প্রায় ১০ মাস সময় লাগে। প্রসবজল পায়ী অজ্ঞ সাধকরা গর্ভধারণের ১০ মাস পরে প্রসূতীদের যে বর্জ্যজল পান করেন, সুবিজ্ঞ সাধকরা তাদের ১০ মাস পূর্বেই পবিত্র অমৃতজল পান করেন। প্রকৃতির নিয়মে ১০ মাস পরে যে ফল পেকে প্রসবিত হয়, পাকা সাধকরা তা ১০ মাস পূর্বেই সাধনবলে আহরণ করে থাকেন। একেই অসময়ে ফল পাকানো বলা হয়।
পরিশেষে বলা যায় সুধা সব সময়ই পবিত্র কিন্তু সাঁইরস বা লালনরস সব সময়ই অপবিত্র। শ্বরবিজ্ঞানে; সুধা-ই সাঁইয়ের পূর্বরূপ বলে স্থূলভাবে সুধাকেও সাঁই বলা হয়। তবে; সুধা ও সাঁইয়ের মধ্যে চিরকালই আকাশ-পাতাল পার্থক্য রয়েছে।
‘আলেক সাঁই’ পরিভাষাটির উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ
(Derivation & evolvement of the ‘miraculous God’ terminology)
আলেক (বাপৌছ)বি অপার্থিব, অলৌকিক, অমানবিক, লৌকিক নয় এমন (ব্য্য) অলৌকিক- এর সংক্ষিপ্ত রূপ (আলেক সাঁই) (শ্ববি) পালনকর্তা, ঈশ্বর, প্রভু, বিষ্ণু, বুদ্ধ, স্বামী, guardian, রব (আ.ﺮﺐ) (রূপ্রশ) উপাস্য, নারায়ণ, নিধি, নিমাই, নিরঞ্জন, স্বরূপ (ইদে) খোদা (ফা.ﺨﺪﺍ), মা’বুদ (আ.ﻤﻌﺑﻭﺪ), মুহাম্মদ (আ.ﻤﺤﻤﺪ), রাসুল (আ.رَسُول) (ইপ) কাওসার (আ.ﻜﻭﺛﺮ), ফুরাত (আ.ﻔﺭﺍﺖ) (ইংপ) God, nectar, elixir (পরি) মানবের ক্ষেত্রে তরল মানুষ; যে এখনও মূর্তাকার ধারণ করে নি। মাতৃগর্ভে ভ্রূণ লালনপালনের দায়িত্ব পালনকারী সুমিষ্ট সুপেয় ও শ্বেতবর্ণের জল (দেপ্র) এটি ‘বাঙালী পৌরাণিক চরিত্রায়ন সত্তা সারণী’ এর ‘পালনকর্তা’ পরিবারের ‘বাঙালী পৌরাণিক ছদ্মনাম পরিভাষা’ ও শ্বরবিজ্ঞানের একটি ‘দেবতা’ বিশেষ (সংজ্ঞা) ১. সর্বপ্রকার অলৌকিক বিষয়বস্তুকে আলেক বলা হয় ২. শ্বরবিজ্ঞানে; অমৃত মানবজলকে আলেক বলা হয় ৩. মাতৃগর্ভে মানব ভ্রূণ লালনপালনে নিয়োজিত অমৃতরসকে পালনকর্তা বা রূপকার্থে আলেক বলা হয় (বাপৌছ) ঈশ্বর, উপাস্য, চোর, পতিতপাবন, প্রভু, পরমগুরু, মনের-মানুষ, রাজা ও স্বরূপ (বাপৌচা) বিষ্ণু, রাম ও লালন (বাপৌউ) অমৃতসুধা, গ্রন্থ, চন্দ্র, জল১, ননি, পক্ষী, ফল, ফুল১, মাণিক ও সুধা (বাপৌরূ) সাঁই (বাপৌমূ) পালনকর্তা।
আলেক ধ্বনি (বাপৌছ)বি বাংলা ‘আলেক সাঁই’ রূপ মহাবাণীকে আলেকধ্বনি বলা হয় {বাং.আলেক+ বাং.ধ্বনি}
‘আলেক সাঁই’ নাদধ্বনির উৎপত্তি
(The derivation of the ‘miraculous God’ roarsound)
‘আলেক সাঁই’ এ মহানাদের দুটি অংশ। যথা; ১. ‘আলেক’ ও ২. ‘সাঁই’।
১. ‘আলেক’ (‘Miraculous’)
অলৌকিক (বাপৌছ)বিণ লোকাতীত, সাধ্যাতীত, মানুষের পক্ষে সম্ভব নয় এমন, ইহলোকের নয় এমন।
অলোক (বাপৌছ)বিণ ১. অলৌকিক, লোকাতীত, সাধ্যাতীত, মানুষের পক্ষে সম্ভব নয় এমন, ইহলোকের নয় এমন ২. নির্জন, বিজন, অসাধারণ, লোক বসতিহীন (ব্য্য) অলৌকিক পরিভাষার সংক্ষিপ্তরূপ (প্র) শ্বরবিজ্ঞানে আত্মজ্ঞানীগণের নির্মিত; ১. জল ২. মাটি ৩. আগুন ৪. অলোক ৫. বাতাস; এ পঞ্চাত্মার একটি।
আলেক (বাপৌছ)বি অপার্থিব, অলৌকিক, অমানবিক, লৌকিক নয় এমন (ব্য্য) ‘অলৌকিক’ পরিভাষার সংক্ষিপ্তরূপ (আলেক সাঁই)।
‘আলেক’ পরিভাষার উৎপত্তি (The derivation of ‘miraculous’ terminology)
বাংলা ‘অলৌকিক’ পরিভাষা হতে, অলোক এবং অলোক পরিভাষা হতে, আলেক পরিভাষাটির উৎপত্তি হয়েছে। অর্থাৎ; অলৌকিক> অলোক> আলেক পরিভাষাটি উৎপত্তি হয়েছে।
২ ‘সাঁই’ (God)
ঈশ্বর (বাপৌছ)বি সৃজক, স্রষ্টা, সৃষ্টিকর্তা (প্রাঅ) বিধাতা, অধিপতি, হৃদয়েশ (প্র) সনাতনীদের পবিত্রস্থান বা মৃতের নামের পূর্বে ব্যবহার্য মহিমাজ্ঞাপক ‘ ঁ ’ চিহ্ন, God, Lord বিণ শ্রেষ্ঠ, প্রধান, গুরুত্বপূর্ণ (পরি) মানবদেহে প্রাপ্ত শুভ্র ও কালোবর্ণের জীবজলদ্বয়কে একত্রে ‘ঈশ্বর’ বলা হয় (শ্ববি) সাঁই, কাঁই, লালন, প্রভু, পতি, স্বামী, প্রণয়ী, গুরু, গোঁসাই (ইংপ) God, Lord (ইদে) রাসুল (ﺮﺴﻮﻝ) ও আল্লাহ (ﺍﻠﻠﻪ) (বাদে) সাঁই ও কাঁই (দেপ্র) এটি ‘বাঙালী পৌরাণিক চরিত্রায়ন সত্তা সারণী’ এর ‘পালনকর্তা’ পরিবারের ‘বাঙালী পৌরাণিক ছদ্মনাম পরিভাষা’ ও শ্বরবিজ্ঞানের একটি ‘দেবতা’ বিশেষ (সংজ্ঞা) ১. সাধারণত; বৈদিক সৃষ্টিকর্তাকে ঈশ্বর বলা হয় ২. শ্বরবিজ্ঞানে; অমৃত মানবজলকে ঈশ্বর বলা হয় (বাপৌছ) ঈশ্বর, উপাস্য, চোর, পতিতপাবন, পরমগুরু, প্রভু, মনের-মানুষ ও সুধা (বাপৌচা) ননি, বিষ্ণু, মাণিক, রাজা, রাম, লালন, স্বরূপ ও হরি (বাপৌউ) অমৃতসুধা, গ্রন্থ, চন্দ্র, জল১, তীর্থবারি, পাখি৬, ফল ও ফুল১ (বাপৌরূ) সাঁই (বাপৌমূ) পালনকর্তা Jস্ত্রী ঈশ্বরী {বাং.ইষ্টি+ বাং.বর> ইষ্টর>}
সাঁই ও কাঁই কিংবা বিষ্ণু ও ব্রহ্মাকে একত্রে ঈশ্বর বলা হয়। তবে; সাধারণত; ঈশ্বর বলতে সাঁই বা বিষ্ণুকেই বুঝাই। সংস্কৃত ঈশ্বর পরিভাষাটির দ্বারা বাংলাভাষার সাঁই ও কাঁই উভয় উপাস্যকেই বুঝায়। এজন্য; ঈশ্বরকে সাঁই ও কাঁই উভয় রূপেই ভজন পুজন করা যায়, মহাকল্যাণকর পরম কাম্য উপাস্যকে ঈশ্বর বলে; যেমন; সাঁই। মানবদেহে প্রাপ্ত শুভ্র ও কালোবর্ণের এই জীবজল দ্বয়কে একত্রে ঈশ্বর বলা হয়। ইষ্ট (আত্মীয়) হতে ঈশ্বর পরিভাষাটির উৎপত্তি। মানবের আদি-লালনপালনকর্তা সাঁই মাতৃগর্ভে সন্তান লালনপালন করেন বলে, তার চেয়ে নিকটতম আত্মীয় বা ইষ্ট আর কেহই হতে পারে না। এজন্য; অত্যন্ত আপন বা অত্যন্ত ইষ্ট হতে ঈশ্বর পরিভাষাটির উৎপত্তি।
বাংলা ঈশ্বর পরিভাষাটির দেহতাত্ত্বিক সত্তা জীবজল বা মানবজল। মানবদেহে প্রাপ্ত ঈশ্বর নামক জীবজল দুই প্রকার। যথা; ১. শ্বেতবর্ণ ঈশ্বর ও ২. কৃষ্ণবর্ণ ঈশ্বর। অর্থাৎ; মানবদেহে প্রাপ্ত শুভ্র ও কৃষ্ণ উভয় বর্ণের জীবজলকে একত্রে ঈশ্বর বলা হয়। শুভ্রজলকে সুধা বা অমৃতসুধাও বলা হয়। শুভ্রবর্ণের জীবজল বা মানবজল সাধারণত; ডাবের জলবৎ বর্ণ ও তত্তুল্য সামান্য মিষ্ট হয়। এর পরিমাণ প্রায় এক পোয়া হতে এক সের পর্যন্ত হয়। অন্যদিকে; কৃষ্ণবর্ণের মানবজল জামের রসের মতো কালো হয়। এর পরিমাণ প্রায় আধা পোয়া হতে এক পোয়া পর্যন্ত হয়। এটি; দেখতে জামের রসবৎ কালো এবং প্রায় মধুবৎ মিষ্ট হয়। নিজ-নিজ দেহ হতে শুভ্রবর্ণের মানবজলের উদ্ঘাটন করার পর, সাধকগণ সাঁইজি উপাধি এবং কৃষ্ণবর্ণের মানবজলের উদ্ঘাটন করার পর, সাধকগণ কাঁইজি উপাধিলাভ করে থাকেন। প্রতিটি মানুষের যৌবনকালের এগারো হতে চল্লিশ (১১-৪০) বছর পর্যন্ত প্রতি মাসেই এ উভয় প্রকার জল একবার করে স্বাধিষ্ঠান চক্রে অবতরণ করে থাকে। শ্বরবিজ্ঞানে; ঈশ্বর নামক এ অমৃতমানবজলের অসংখ্য নাম রয়েছে। এ দুই প্রকার মানবজল আহরণ ও সেবনকে কেন্দ্র করেই বিশ্বের সব মরমীসঙ্গীত ও মহা গ্রন্থাদি নির্মিত হয়েছে। বেদ, ত্রিপিটক, তৌরাত, যাবুর, ইঞ্জিল, কুরান, লালন ও বলন ইত্যাদি মহাগ্রন্থ, এ দুটি মানবজলকে কেন্দ্র করেই গড়ে ওঠেছে। আত্মতত্ত্ব হতে ছিটকে পড়ার কারণেই; পরবর্তীকালে এসব পুরাণ ‘অন্ধবিশ্বাসের সাগর’ এর মতো সাম্প্রদায়িক গ্রন্থে পরিণত হয়েছে। স্মরণীয় যে; শ্বরবিজ্ঞানের ভিত্তি আত্মতত্ত্বের ওপর এবং সাম্প্রদায়িক গ্রন্থাদির ভিত্তি অন্ধবিশ্বাসের ওপর।
‘সাঁই’ পরিভাষাটির উৎপত্তি (The derivation of ‘God’ terminology)
সাদা + ঈশ্বর = সাঈ (উভয় শব্দের প্রথম বর্ণ গ্রহণ করে)। ‘সাঈ’ পরিভাষাটির দীর্ঘই (ঈ) বর্ণটির দীর্ঘস্বর পড়তে কষ্ট হয়। এজন্য; পড়ার সুবিধার্থে দীর্ঘই (ঈ) বর্ণটিকে হ্রস্বই (ই) বর্ণ দ্বারা পরিবর্তন করে এবং সে পরিবর্তনের চিহ্নস্বরূপ একটি চন্দ্রবিন্দু “ ঁ ” গ্রহণ করে, ‘সাঈ’ পরিভাষাটি হতে ‘সাঁই’ পরিভাষাটির উৎপত্তি হয়েছে।
সাঁই (বাপৌছ)বি ঈশ্বর, প্রভু, বুদ্ধ, পতি, স্বামী (বাদে) বিষ্ণু (গ্রিদে) God (ইদে) রাসুল (رَسُولَ), রব (ﺮﺏ), মুহাম্মদ (ﻤﺤﻤﺪ) {(সাদা+ঈশ্বর)> (সা+ঈ)> সাঈ>}
পরবর্তীতে ‘সাঁই’ পরিভাষা হতেই ‘সাঁইজি’ পরিভাষাটির উৎপত্তি। বাংলা ‘সাঁই’ এবং তুর্কি ‘জি (ﺠﻰ)’ পরিভাষাদ্বয় একত্রিত করে (সাঁই+জি) হতে “সাঁইজি” পরিভাষাটি সৃষ্টি করা হয়েছে।
সাঁইজি (বাপৌছ)বি প্রাণনাথ, প্রাণপতি, প্রাণস্বামী, প্রাণেশ্বর, বিশ্বনাথ, বিশ্বপতি বিণ বৈষ্ণব, সাঁইবিহারী, সাঁইচারী (পরি) জ্ঞানের নৈরাকার স্তর এবং রসাশ্রয় ও রূপাশ্রয় হতে এ ‘সাঁইজি’ সম্প্রদায়ের উৎপত্তি (প্র) ১. সাঁইদর্শনকারী সাধক সাধিকার উপাধি বিশেষ ২. সাঁই বা লালনপালনকর্তার সাথে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে দর্শনলাভকারী ৩. শ্বরবিজ্ঞানের আউল, বাউল, নাড়া ও সাঁইজি এ চতুর্সাধন পথের সর্বশেষ পথ বিশেষ (পরি) জ্ঞানের নৈরাকার স্তর এবং রসাশ্রয় ও রূপাশ্রয় হতে ‘সাঁইজি’ সম্প্রদায়ের উৎপত্তি (গ্রিদে) Godship (ইদে) ‘إلهية’ (ইলহিয়া), নায়েবে রাসুল (ﻧﺎﺌﺐ ﺮﺴﻭﻞ) {বাং.সাঁই+ স.জি}
জি [ﺠﻰ] অব্য নামের পরে ব্যবহৃত সম্বোধনসূচক শব্দ (নানাজি) {তু}
বিশ্বের প্রায় সব ভাষাতেই দুই প্রকার মহানাদ দেখতে পাওয়া যায়। যথা; ১. রাজনৈতিক মহানাদ ও ২. সাম্প্রদায়িক মহানাদ।
১. রাজনৈতিক মহানাদ (The political greatroar)
রাজনৈতিক অঙ্গনে সভা সমাবেশ ও গণসংযোগের জন্য ব্যবহৃত উচ্চ ধ্বনিকে রাজনৈতিক মহানাদ বলে। যেমন; জয় বাংলা, বন্দে মাতারম ও আরবি ভাষায় নারায়ি তাকবির ইত্যাদি।
২. সাম্প্রদায়িক মহানাদ (The schismatical greatroar)
সাম্প্রদায়িক ও আধ্যাত্মিক অঙ্গনে সভা সমাবেশ ও সাধু সম্মেলনের জন্য ব্যবহৃত উচ্চ ধ্বনিকে সাম্প্রদায়িক মহানাদ বলে। যেমন; আলেক সাঁই, জয় গুরু, গুরু ভরসা ও আরবি ভাষায় আল্লাহ আকবার ইত্যাদি।
রাজনৈতিক সভা ও সমাবেশে যেমন উচ্চস্বরে ‘জয় বাংলা’ বলে, উপস্থিত নেতা কর্মীদের মনে সাহস ও মনোবল বৃদ্ধি করা হয়। তেমনই; সাম্প্রদায়িক ও আধ্যাত্মিক সভা ও সমাবেশে ‘আলেক সাঁই’ বলে উপস্থিত সাধু সাথী ও সমর্থকদের মন আকর্ষণ করা হয়। বাংলাভাষার মহান লেখনি সৈনিক, মহাত্মা লালন সাঁইজি, বাংলাভাষায় ‘আলেক সাঁই’ এ মহানাদ আবিষ্কার করেন। যারফলে; বাংলাভাষায়, মহানাদের যে অভাবটুকু ছিল, তা পূরণ হয় চিরদিনের জন্য। তখন হতেই ‘আলেক সাঁই’ মহানাদটি বিভিন্ন সাধুসঙ্গ সাধু সম্মেলন ও সাধুসভায় ব্যবহার হয়ে আসছে। তবে; বর্তমানে লালন ঘরানার কোথাও কোথাও মহানাদ রূপে “আল্লাহ আলেক” এমন চরম বিভ্রান্তিকর বাণীও, ব্যবহার করতে দেখা যাচ্ছে। ‘আল্লাহ আলেক’ বাণীটি একেবারে ভুল। কারণ; আল্লাহ (ﺍﻟﻟﻪ) পরিভাষাটি আরবি এবং এটি; মুসলমানী একটি পরিভাষা। আল্লাহ (ﺍﻟﻟﻪ) পরিভাষাটি নিতান্তই ইসলামী সাম্প্রদায়িক মতবাদের সাম্প্রদায়িক সম্পদ। এক সাম্প্রদায়িক মতবাদের লোক অন্য সাম্প্রদায়িক মতবাদের সাম্প্রদায়িক পরিভাষা ব্যবহার করা, সাম্প্রদায়িক মতবাদ চুরি করারই নামান্তর। যেহেতু; লালন ঘরানা বর্তমানে পূর্ণাঙ্গ একটি সাম্প্রদায়িক মতবাদ রূপে গণ্য; যাকে ‘মানবধর্ম’ বলা হয়। এজন্য; স্বয়ং সম্পূর্ণ একটি সাম্প্রদায়িক মতবাদের স্বকীয়তা অটুট রাখার জন্য, এমন পরিভাষা চুরির মত হীন কর্ম হতে বিরত থাকাই অধিক উত্তম। হ্যাঁ ‘আলেক সাঁই’ পরিভাষাটি বা মহানাদটি যদি না থাকত, তবে অগত্য ‘আল্লাহ আলেক’ মহানাদটি ব্যবহার করাই কোনো দোষ হতো না। যেহেতু; ‘আলেক সাঁই’ মহানাদটি রয়েছে, সেহেতু ‘আল্লাহ আলেক’ এটি; বলা ও ব্যবহার করা সমীচীন নয় বলে আমরা মনে করি।
আবার যে মুসলমানরা, লালনপন্থীদের চরম ও পরম শত্রু। তারা পুনঃপুন লালনপন্থীদের চুল দাড়ি ও মুচ কেটেছে। তারা পুনঃপুন লালনশিল্পী ও বাউলদের একতারা ভেঙ্গেছে। পুনঃপুন লালন সম্প্রদায়কে নিশ্চিহ্ন করার ব্যর্থ পরিকল্পনা করেছে। সে লালনপন্থীরা তাদের নিজস্ব পরিভাষা রেখে, কেন সে-ই মুসলমানদের পরিভাষা ব্যবহার করবেন? এজন্য; আামাদের পরামর্শ হলো; বাংলা ভাষায় বাঙালী পরিভাষা থাকতে, কোনো বিদেশী পরিভাষা ব্যবহার করা, কোনো বাঙালীর উচিত নয়। এমন করলে বাংলা ভাষা ও বাঙালীজাতির সঙ্গে চরম বিশ্বাসঘাতকতা করা হয় বলে আমরা বিশ্বাস করি। মহাত্মা লালন সাঁইজি কর্তৃক নির্মিত ‘আলেক সাঁই’ মহানাদটি যেসব ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়, তা নিচে এসবের বিবরণ তুলে ধরা হলো;
(ক) অভিবাদন বার্তা রূপে ‘আলেক সাঁই’
(The ‘miraculous God’ as salutation message)
এ ঘরানার নিয়ম অনুযায়ী, নর হোক বা নারী হোক কিন্বা একজন নর ও একজন নারী হোক, যে কোনো দুই ব্যক্তির সাক্ষ্যাত হওয়া মাত্রই ‘আলেক সাঁই’ মহাবাণী দ্বারা সম্বোধন করা হয়। অতঃপর; কুশলগুলো বিনিময় করে, সর্বপ্রথম চাল ও জল দ্বারা তাঁকে আপ্যায়ন করা হয়। এ সূত্র হতেই দূরালাপনি বা আলাপির দ্বারা, এ ঘরানার প্রেমিক, অনুরাগী, ভক্ত ও অনুসারীরা, কোনো সংবাদাদি আদান প্রদানের পূর্বে, ‘আলেক সাঁই’ বলে উভয়ে উভয়কে সম্বোধন করে থাকেন। বিশ্বের সর্ব ভাষাতেই এক বা একাধিক সম্বোধনবাণী রয়েছে। তেমনই; বাংলা ভাষাতেও কিছু সম্বোধনবাণী রয়েছে। যেমন; আলেক সাঁই, গুরুপদে প্রেমভক্তি, গুরু ভরসা, জয় গুরু, জয় নেংটা বাবা, জয় বাবা লাডুম শাহ, জয় বাবা লোকনাথ, দয়াল ভরসা ইত্যাদি। অন্যদিকে; রাজনৈতিক স্লোগান হচ্ছে- ‘জয় বাংলা’।
লালনপন্থীদের সম্বোধনবাণী- ‘আলেক সাঁই’
সেকিমপন্থীদের সম্বোধনবাণী- ‘গুরুপদে’ (গুরুপদে প্রেমভক্তি বাক্যের সংক্ষিপ্ত রূপ)।
আহলে বাইয়াতপন্থীদের সম্বোধনবাণী- ‘গুরু ভরসা’ ও ‘জয় গুরু’
সোলেমান নেংটাপন্থীদের সম্বোধনবাণী- ‘জয় নেংটা বাবা’
লাডুমশাহপন্থীদের সম্বোধনবাণী- ‘জয় বাবা লাডুম শাহ’
লোকনাথপন্থীদের সম্বোধনবাণী- ‘জয় বাবা লোকনাথ’
শাহলালপন্থীদের সম্বোধনবাণী- ‘দয়াল ভরসা’
উয়াইসিয়াপন্থীদের সম্বোধনবাণী- ‘ইয়া আলী মদদ’
এছাড়াও; সম্বোধন বা আশির্বাদবাণী রূপে ‘ওঁম শান্তি’ বাণীটি বঙ্গদেশে অতি প্রাচীনকাল হতে ব্যবহার হয়ে আসছে। নিচে এর সংক্ষিপ্ত বিবরণ তুলে ধরা হলো।
অ অ ম; এ ৩টি সাংকেতিক চিহ্নের সমাহার, এটি; সব মন্ত্রের আদিবীজ বা ‘প্রণব’। এর অন্যনাম ‘ওঁম’। আঁজি বা আদ্যক্ষর, সর্বপ্রকার অক্ষর বা ধ্বনির আদ্য বীজ। এটি; সনাতনী সমাজের বিশ্বাসের একটি তাৎপর্যপূর্ণ অঙ্গ। অদিতি- (পৃথিবী, বসুন্ধরা, ধরা), অন্তরীক্ষ- (মহাশূন্য, পৃথিবী ও মহাকাশের মধ্যভাগ), মহাকাশ- (নভোমণ্ডল, আকাশ) অদিতি হতে ‘অ’ অন্তরীক্ষ হতে ‘অ’ এবং মহাকাশ হতে ‘ম’ যোগে গঠিত করা হয় ‘অঅম’ অতঃপর; “অঅম” হতে {অঅম> অওম> ওঁম} বা {ওঁম} হয় (ব্য্য) প্রথমে মধ্যবর্তী ‘অ’ বর্ণটিকে ‘ও’ বর্ণদ্বারা পরিবর্তন করা হয় এবং প্রথম ‘অ’ বর্ণকে বিলুপ্ত করে, উক্ত বিলুপ্তির চিহ্ন স্বরূপ ‘ও’ বর্ণটির মাথার ওপর ‘ ঁ ’ বর্ণটি স্থাপন করে, ‘ওঁম’ পরিভাষাটির উৎপত্তি হয়। অথবা অ বর্ণটির নিচে অ অক্ষর লিখে আকার (া) এর মতো (্ম)- এ টানটিকে উঠিয়ে দিয়ে, তার চিহ্ন স্বরূপ এর মাথার ওপর, একটি চন্দ্রবিন্দু বসান হয়েছে। আবার {ওঁম < অওম < অঅম} অর্থাৎ; ‘ওঁম’ অর্থ পৃথিবী, অন্তরীক্ষ ও মহাকাশ বা সমন্ত সৃষ্টি জগৎ বুঝায়।
এবার ‘ওঁম শান্তি’ দ্বারা সমস্ত সৃষ্টি জগতে শান্তি বুঝায়। কারণ; শুধু পৃথিবীতে শান্তি হলে এবং অন্তরীক্ষে অশান্তি হলে অর্থাৎ; অশান্তিকর জলবায়ু দেখা দিলে, পৃথিবীতেও অশান্তি দেখা দিবে। আবার পৃথিবী ও অন্তরীক্ষে শান্তি হলে, মহাকাশে অশান্তি হলে অর্থাৎ; সূর্য ও চন্দ্রে বা নক্ষত্রে ও নক্ষত্রে বা গ্রহ ও নক্ষত্রে ধাক্কাধাক্কি ও ঠেলাঠেলির সৃষ্টি হলে, কিংবা জ্যোতিষ্কগুলো ভেঙ্গে পড়লে, পৃথিবীতে অশান্তি দেখা দিবে। এজন্য; প্রায় চার হাজার বছর পূর্বে বাঙালী মহাজ্ঞানী সাধু সন্ন্যাসীগণ পৃথিবী, অন্তরীক্ষ ও মহাকাশকে একত্রে সন্নিবেশিত করে, উক্ত ‘ওঁম’ নামক অমীয় শান্তির বাণী উদ্ভাবন করেন। যাতে বিধাতার সৃষ্টি জগতের, কোথাও যেন অশান্তি না থাকে। কালক্রমে পরবর্তীকালে ভারত বর্ষীয় মনীষীগণ নমস্কার, নমস্তুতি, নমস্তি, প্রণাম, জয় হোক, ও শুভ হোক, আরবি মনীষীগণ ‘সালাম-(শান্তি), আচ্ছালাম-(শান্তি), ‘আচ্ছালামু আলাই- (শান্তি হোক), ‘আচ্ছালামু আলাইকুম- (আপনাদের ওপর শান্তি), ‘আচ্ছালামু আলাইকা- (আপনার (পুরুষের) ওপর শান্তি), ‘আচ্ছালামু আলাইকি- (আপনার (নারীর) ওপর শান্তি)’ ইত্যাদি। ইংরেজি মনীষীগণ, Good morning অর্থ; শুভ সকাল। Good afternoon অর্থ; শুভ বিকাল, Good evening অর্থ; শুভ সন্ধ্যা, Good night অর্থ; শুভ রাত্রি ইত্যাদি সম্বোধনবাণী উদ্ভাবন করেছেন। কিন্তু ব্যবপকতা ও বিশালতার দিক দিয়ে, প্রায় চার হাজার বছর পূর্বে সৃষ্ট শান্তির বাণী ‘ওঁম’ এর নিকট অনেক পরে সৃষ্ট, সম্বোধনবাণী বা শান্তির বাণীগুলো শিশু তুল্য বৈ নয়।
কালক্রমে অনেক সম্বোধনবাণী উদ্ভাবন হলেও বাঙালী সাধুগণের উদ্ভাবিত ‘ওঁম’ এর মতো মহাগুরুত্ব বহনকারীবাণী, আজও উদ্ভাবিত হতে দেখা যায় নি বিশ্বের কোথায় {স. অ + অ +ম >}
ওঁমশান্তি (বাপৌছ)বি বাংভারতীয় উপমহাদেশের বন্দনা বা আশির্বাদবাণী বিশেষ।
বর্তমানে লালনপন্থীদের মধ্যেও বিশেষ এক সম্বোধনবাণীর প্রচলন দেখা যায়। লালন প্রেমিক, লালন অনুরাগী, লালন ভক্ত, লালন অনুসারী ও লালন ঘরানার একজন, অন্য কাউকে দেখতে পেলেই উভয়েই আলেক সাঁই বলে সম্বোধন করে করমর্দন করে থাকেন। আবার আলাপীর মাধ্যমে কথা বলার সময়ে তারা একে অন্যকে ‘আলেক সাঁই’ বলেই সম্বোধন করে থাকেন। এককথায় বলা যায় বাংলাদেশের অন্যান্য আশ্রমগুলো হতে লালনাশ্রমের সম্বোধনবাণী, নাদধ্বনি, ভক্তি, ভজন ও ভোজন সম্পূর্ণ ভিন্ন ও অভিনব। এছাড়াও; কুমিল্লার বেলতলির সোলেমান নেংটা বাবার অনুসারীরা ‘জয় বাবা নেংটা’ বা ‘দোহাই নেংটা‘ বলে, শরিয়তপুরের কারী আব্দুল হক্বের অনুসারীরা ও সেকিমচাঁদপন্থীরা ‘গুরুপদে‘ (গুরুপদে প্রেমভক্তি এর সংক্ষিপ্ত রূপ) বলে, নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ের বারদির লোকনাথ বাবার অনুসারীরা ‘জয় বাবা লোকনাথ’ বলে, সুফিবাদীরা ‘গুরু ভরসা’ বলে, আত্মজ্ঞানীগণ ‘জয়গুরু’ বলে ও হরিভক্তরা ‘হরিবল’ বলে একে অন্যকে বাংলা ভাষায় সম্বোধন করে থাকেন।
(খ) অন্ন-পানীয় গ্রহণের অনুমতি বার্তা রূপে ‘আলেক সাঁই’
(‘Miraculous God’ as a message allowed to accept food and drink)
লালন ঘরানার যে কোনো আশ্রমেই অন্ন বা প্রসাদ পরিবেশনের পর- অন্ন বা প্রসাদ গ্রহণের অনুমতি স্বরূপ ‘আলেক সাঁই’ মহানাদ উচ্চারণ করা হয়। লালন ঘরানার অনুযায়ী, যে কোনো অন্ন বা প্রসাদ প্রদান করা হলেই, আয়োজক কর্তৃপক্ষের অনুমতি ব্যতীত, তা ভক্ষণ করার নিয়ম নেই। তাদের মতে; সবাই একসঙ্গে অন্ন গ্রহণ ব্যতীত, একাকী অন্ন বা প্রসাদ গ্রহণ করা, কারো পক্ষেই উচিত নয়। তাই; তারা বলে থাকেন- “পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ভক্ষণ- ছাগলের লক্ষণ।” এজন্য; যে কোনো অনুষ্ঠানে, যে কোনো অন্ন বা প্রসাদ পরিবেশনের পর আয়োজক কর্তৃপক্ষের মহানাদের অপেক্ষায় বসে থাকতে হয়। আয়োজকদের পক্ষ হতে মহানাদ উচ্চারিত হলেই, কেবল অন্ন বা প্রসাদ গ্রহণ করা আরম্ভ করতে হয়।
‘আলেক সাঁই’ ধ্বনি উচ্চারণকারীর বিবরণ
(The description of the ‘miraculous God’ sound talker)
নারীবৎ লম্বা চুল বিশিষ্ট, যে কোনো ব্যক্তি, উদাম মাথায় মহানাদ ‘আলেক সাঁই’ উচ্চারণ করতে পারবেন। তবে; যাদের মাথায় চুল নেই, তারা একটি গামছা বা অন্য কোনো কাপড় মাথায় দিয়ে, মহানাদ ‘আলেক সাঁই’ বাণীটি উচ্চারণ করতে পারবেন। মহানাদকারী নারীবৎ লম্বা চুলবিশিষ্ট হওয়ার কারণ হলো; এ ঘরানা অনুযায়ী, যারা শুক্রকে নিয়ন্ত্রণ করে, নর হওয়া সত্ত্বেও, নারী চরিত্র ধারণ করতে পেরেছেন, তারাই সিদ্ধ সাধক। তাদের ধারণা হলো; যেমন; নারীর নিকট কোনো শুক্র নেই; তেমনই; ঊর্ধ্বরেতা সাধকের নিকটও শুক্র নেই। এজন্য; একজন নারী ও একজন সিদ্ধ সাধকের মধ্যে, মৌলিক কোনো পার্থক্য নেই। তাই; নারীচরিত্র গ্রহণকারী এমন সিদ্ধ সাধকগণই এ মহামান্য ‘আলেক সাঁই’ ধ্বনি উচ্চারণের অধিক উপযুক্ত। এ সূত্র হতেই; তারা পুরুষের নারীবৎ লম্বা চুল রাখার প্রথা উদ্ভাবন করেছেন। তাদের মতে; ঊর্ধ্বরেতা হওয়ার পূর্বে, কোনো সাধকই লম্বা চুল রাখতে পারবেন না। ঊর্ধ্বরেতা হওয়ার পরই কেবল স্বস্ব গুরুর গোঁসাইয়ের নিকট হতে, নারীবৎ লম্বা চুল রাখার অনুমতি পাওয়া যায়, বা দেওয়া হয়।
আবার যাদের মাথায় চুল নেই, তারা একটি গামছা বা অন্য কোনো কাপড় মাথায় দিয়ে, এ মহামান্য ‘আলেক সাঁই’ ধ্বনি উচ্চারণ করতে পারবেন- এমন করার কারণ হলো; সব সময় সিদ্ধ সাধক পাওয়া যায় না। আর সিদ্ধ সাধক ছাড়া নারীবৎ লম্বা চুল রাখারও, কোনো অনুমতি নেই। লম্বা চুল যেভাবে সমস্ত মাথাকে ঢেকে রাখে; তেমনই; পরিধানকৃত বসন ভিন্ন, গামছা বা অন্য কোনো কাপড় দিয়ে সারামাথা আচ্ছাদিত করলে, মানুষকে নারীবৎই মনে হয়। এজন্য; তারা চুলের পরিবর্তে, গামছা বা অন্য কোনো কাপড় মাথায় দিয়ে, মহানাদ ‘আলেক সাঁই’ ধ্বনি উচ্চারণ করার প্রথা উদ্ভাবন করেছেন। তবে; এটা অগত্য পড়েই করা হয়। যেমন; কখনও কখনও দুধ না পাওয়া গেলে- ‘ঘোল’ পান করা হয়। অর্থাৎ; দুধের স্বাদ ঘোল দ্বারা মিটানো হয় আর কী।
নারীবৎ লম্বা চুলবিশিষ্ট ব্যক্তি উদাম মাথায় ও লম্বা চুলহীন ব্যক্তি গামছা বা অন্য কোনো কাপড় পরিহিত অবস্থায়, সর্ব সম্মুখে মহানাদ ‘আলেক সাঁই’ বলে, একটি ভক্তি দিয়ে থাকেন। ‘আলেক সাঁই’ নামক এ মহানাদই অন্ন বা প্রসাদ গ্রহণের অনুমতিবাণী। তবুও; ভক্তিদাতা আবার ‘আলেক সাঁই’ বলে ভক্তি হতে মাথা উত্তোলন করে, আবার উচ্চস্বরে বলে থাকেন- “নিন গো সাধু গুরুগণ, যার যার সেবা নিন।” এরপর সবাই অন্ন বা প্রসাদ গ্রহণ আরম্ভ করে থাকেন। সভা বা সমাবেশ বড় হলে- ভক্তিদাতার কণ্ঠের সাথে কণ্ঠ মিলিয়ে, মুখে মুখে বা যে কোনো শব্দালের (মাইক) দ্বারা অন্য এক বা একাধিক ব্যক্তি বসে বসে বা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সর্বোচ্চ স্বরে, একবার মহানাদ ‘আলেক সাঁই’ ধ্বনিটি উচ্চারণ করে থাকেন- যা সভা বা সমাবেশের সবাই শুনতে পান। সভা বা সমাবেশ ছোট হলে, কোনো শব্দাল ব্যবহার করা হয় না। শুধু মুখে মুখেই ‘আলেক সাঁই’ এ মহানাদ ধ্বনিটি একবার উচ্চারণ করা হয।
(গ) প্রতি গণভক্তির পূর্বে ‘আলেক সাঁই’ ধ্বনির ব্যবহার
(Use of ‘miraculous God’ slogans before the every public-piety)
প্রাতঃভক্তি মধ্যাহ্ন ভক্তি ও সান্ধভক্তি বা অন্য কোনো বিশেষ গণভক্তির পূর্বে, সর্ব সাধারণের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য, বা সবাইকে একসঙ্গে ভক্তি প্রদানের সুবিধা করে দেওয়ার জন্য ‘আলেক সাঁই’ নামক এ মহানাদ ধ্বনি সর্বোচ্চ স্বরে উচ্চারণ করা হয়। যারফলে; উপস্থিত সবাই প্রায় একই সঙ্গে, ভক্তি প্রদান করতে পারেন। তবে; একমাত্র গণভক্তি ব্যক্তি ব্যতীত একাকিভক্তির জন্য কখনই ‘আলেক সাঁই’ এ মহাধ্বনি উচ্চস্বরে উচ্চারণ করা হয় না।
(ঘ) প্রত্যেক বিপদের সময় ‘আলেক সাঁই’ ধ্বনির ব্যবহার
(Use of ‘miraculous God’ slogans the every time of danger)
লালন ঘরানা অনুযায়ী যে কোনো কঠিন বিপদের সময় অতি উচ্চস্বরে ‘আলেক সাঁই’ মহানাদটি পুনঃপুন উচ্চারণ করা হয়। যেমন; প্রবল ঝড়বৃষ্টি, ঝড় প্রবাহ, শিলাবৃষ্টি, ভূমিকম্প, চুরি, দস্যুতা বা যে কোনো সতর্কতার জন্য ‘আলেক সাঁই’ মহানাদটি উচ্চারণ করা হয়।
তথ্যসূত্র (References)
(Theology's number formula of omniscient theologian lordship Bolon)
১ মূলক সংখ্যা সূত্র (Radical number formula) "আত্মদর্শনের বিষয়বস্তুর পরিমাণ দ্বারা নতুন মূলক সংখ্যা সৃষ্টি করা যায়।"
রূপক সংখ্যা সূত্র (Metaphors number formula)
২ যোজক সূত্র (Adder formula) "শ্বরবিজ্ঞানে ভিন্ন ভিন্ন মূলক সংখ্যা-সহগ যোগ করে নতুন যোজক রূপক সংখ্যা সৃষ্টি করা যায়; কিন্তু, গণিতে ভিন্ন ভিন্ন সংখ্যা-সহগ যোগ করে নতুন রূপক সংখ্যা সৃষ্টি করা যায় না।"
৩ গুণক সূত্র (Multiplier formula) "শ্বরবিজ্ঞানে এক বা একাধিক মূলক-সংখ্যার গুণফল দ্বারা নতুন গুণক রূপক সংখ্যা সৃষ্টি করা যায়; কিন্তু, মূলক সংখ্যার কোন পরিবর্তন হয় না।"
৪ স্থাপক সূত্র (Installer formula) "শ্বরবিজ্ঞানে; এক বা একাধিক মূলক সংখ্যা ভিন্ন ভিন্ন ভাবে স্থাপন করে নতুন স্থাপক রূপক সংখ্যা সৃষ্টি করা যায়; কিন্তু, মূলক সংখ্যার কোন পরিবর্তন হয় না।"
৫ শূন্যক সূত্র (Zero formula) "শ্বরবিজ্ঞানে মূলক সংখ্যার ভিতরে ও ডানে শূন্য দিয়ে নতুন শূন্যক রূপক সংখ্যা সৃষ্টি করা যায়; কিন্তু, মূলক সংখ্যার কোন পরিবর্তন হয় না।"
< উৎস [] উচ্চারণ ও ব্যুৎপত্তির জন্য ব্যবহৃত () ব্যুৎপত্তির জন্য ব্যবহৃত > থেকে √ ধাতু => দ্রষ্টব্য পদান্তর :-) লিঙ্গান্তর অতএব × গুণ + যোগ - বিয়োগ ÷ ভাগ
- A great 70% flat rate for your items.
- Fast response/approval times. Many sites take weeks to process a theme or template. And if it gets rejected, there is another iteration. We have aliminated this, and made the process very fast. It only takes up to 72 hours for a template/theme to get reviewed.
- We are not an exclusive marketplace. This means that you can sell your items on PrepBootstrap, as well as on any other marketplate, and thus increase your earning potential.